top of page

জয় গোপাল

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • Dec 31, 2023
  • 5 min read

কলকাতার শীতের আমেজ, ভরদুপুর বেলায় চা খাবার ইচ্ছে কে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত বাড়ির সবাই দুপুরের খাবারের তোড়জোড় করছে তাই এই সময় চা খেতে চাওয়ার দুঃসাহস দেখানোর থেকে চুপি চুপি নিজে চা করে নেওয়া অনেক বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল। আফশোষ, ঘরের কোনো কাজ না করার অভিজ্ঞতার মাসুল যে এই ভাবে দিতে হবে সেটা ভাবতে পারি নি।


সময়ের সাথে চায়ের কেটলিরও পরিবর্তন ঘটেছে আমার জীবনের মতন। উনুন বা গ্যাসের গনগনে আগুনের পরিবর্তে মিহি বৈদ্যুতিক শক্তিতেই গরম হয়ে যায়। বেশ কয়েক মিনিট বাদে আবিষ্কার করলাম, কেটলির আলো জ্বলছে না। জল গরম হচ্ছে যদিও। সংসারে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার সুযোগ খুব বেশি আসে না আর তাই গলা টা একটু গম্ভীর করে বললাম - "অনেক দিন তো হলো এই কেটলি টার। আলো না জ্বললে ঠিক বোঝাও যায় না, জল ঠিক মতন গরম হচ্ছে কি না! এবার একটা নতুন কেটলি কিনলে হয় না?'


স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো মেয়ে খাবার টেবিল থেকে মসৃণ সুরে ডাক দিল - "বাবা একবার একটু এদিকে এসো।' এত মিষ্টি করে মেয়ের ডাক কি উপেক্ষা করা যায়? কাছে যেতেই গলার স্বরটা কেমন যেন পাল্টে গিয়ে চল্লিশ বছর আগের শোনা স্কুলের দিদিমণির মতন শোনালো...


-"Don't try to fix things unless it's broken.'


মনের চা খেতে চাওয়ার ইচ্ছে যে জীবনের সারমর্ম বোঝাতে পারে সেটা আগে থেকে জানতে পারলে, দুপুরের আমেজে চা খাবার মতন নির্মল আর বিশুদ্ধ বায়নাও অবদমিত করে রাখার শক্তি খুঁজে পেতাম নিজের মধ্যে।বিগত কয়েক মাসের এই রকম বেশ কিছু মুহূর্ত বোধহয় আমাকে পথ দেখাচ্ছে , গৃহপালিত পুরুষের সন্ন্যাস নেবার মতন এক মায়াবী বোহেমিয়ান স্বপ্ন পূরণের। এই যেমন সপ্তাহ তিনেক আগে পাওয়া জীবনের আর এক সারমর্ম।


সপ্তাহ তিনেক আগে এই বছরের শীত পড়লো আর কলকাতার শীত মানেই অধেল ছুটি ও তার সাথে আনুসঙ্গিক আনন্দের অনাবিল ফোয়ারা। কিন্তু মন চাইলেই তো সব কিছু হাততালি দিয়ে পাওয়া যায় না। এই যেমন মন খুলে একটু আনন্দ ফুর্তি করার মধ্যেও কলকাতা পুলিশ নিজের নাক টা গলিয়ে দিয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মতন কলকাতা পুলিশও কর্পোরেট সংস্কৃতি তে নিজেদের কে রূপান্তর করছে আর তার ফলস্বরূপ ওদেরও এখন মাসের শেষে নম্বর দেখাতে হয়। যত ফুঁ, তত নম্বর। বাড়িতে নিজের মান-সম্মান খুব একটা বেশি বেঁচে নেই, তার উপর পুলিশের নম্বর বাড়ানোতে সাহায্য করে সেই সম্মানের সৌধ স্থাপন করা খুব একটা বিবেচকের কাজ নয়। অতএব, নিজের আনন্দ ফুর্তি তে লাগাম! এই ভাবে কি বাঁচা যায়?


বিদ্রোহী মন অবশেষে শীত পড়ার আনন্দে আত্মহারা। অফিস ফেরত দু-দশক ধরে আঁকড়ে থাকা বন্ধুত্বের স্মৃতি রোমন্থন শেষ করে যখন কলকাতা পুলিশের কথা মনে পড়লো, তখন আর কিছু করার নেই। এখন যদি ফুঁ দিতে হয় তাহলে ওদের শুধু নম্বর বাড়বে এটা নয়, বোনাস ও পেয়ে যাবে। সাপের ছুঁচো গেলার মতন অবস্থা আমার। অফিস ফেরত আনন্দ করে গাড়ি ছাড়া বাড়ি ফেরার কৈফিয়ত দেবার মতন বুকের পাটা ভগবান দিলে ছুঁচোটা গিলে ফেলতাম।


বন্ধুরা ভগবান। এটাই ছোটবেলা থেকে বিশ্বাস করে এসেছি। বিশ্বাস আরো একবার দৃঢ় হলো। এক পরম বন্ধু আমার জন্য ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া আনন্দের দু ফোঁটা জল মনে করিয়ে দিল, জীবন কি সুন্দর!


কলকাতার রাস্তা দিয়ে আমার গাড়ি পক্ষিরাজের মতন উড়ছে, আমি জানলায় মুখ বাড়িয়ে চেটে পুটে নেওয়া ঠান্ডা বাতাসে আহ্লাদে আটখানা। গল্ফগ্রিনের মোড় টা পেরোতেই দেখি, গাড়ির গতি একদম কমে গেল। সামনে নম্বর গোনা চলছে। মন আরো খুশিয়াল হয়ে গেল ছোটবেলার জল-কুমির খেলার স্মৃতি রোমন্থনে। এই কুমির দ্যাখ, আমি তোর জলে নেমেছি....


-"গাড়ি টা সাইড করুন'। যা বাব্বা, গাড়ি কেন সাইড করবো। গাড়ির সব কাগজ আপ-টু -ডেট । আমি তো ফুঁ দেই নি। এই হয়রানির মানে কি?

-"যা বলবে, আমাদের স্যার বলবেন । সাইড করুন আর আপনি নেমে ওই স্যারের সাথে কথা বলুন। মালিক - ড্রাইভার সবাই মিলে নেশা করবেন আর বলবেন আমরা হয়রানি করছি আপনাদের?'

পরম বন্ধুদের ফোন পাচ্ছি না আর তার সাথে ট্রাফিক সার্জেন্টের ক্রমাগত চাপ, গাড়ি আর আপনাদের দুজন কে থানায় যেতে হবে। চোখের সামনে খড়কুটো ভেসে যাচ্ছে। পরের দু-ঘণ্টায় থানা এবং সরকারি হাসপাতাল ঘুরে থানার হৃদয়স্পর্শী অফিসারের পরামর্শ কানে বাজছে।


-"Don't blame your destiny if you are not in a position to take right decision".


জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত থেকে পাওয়া জ্ঞান , অযাচিত উপদেশ আর সংসারের সাঁড়াশি চাপ থেকে মুক্তি পেতে আমি এখন একজন সাধুর খোঁজ চালাচ্ছি, যে আমাকে সিদ্ধিলাপে সাহায্য করবে। কেউ বলছে হৃষিকেশ, কেউ বলছে বেনারস আবার কেউ বলছে পুনে! ভেলকিবাজি কি না জানি না, হটাৎ করে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতন, অফিস ফেরত রাস্তাতে খুঁজে পেলাম বুতাই দাকে। আমার পুরোনো পাড়ার বুতাই দা, আমাদের বয়:সন্ধিকালের সব কৌতূহলের সমাধান করে দেবার ম্যাজিকম্যান। সময়ের নিজের নিয়মে কোথায় হারিয়ে গেছিলো সেটা খেয়াল করে উঠতে না পারলেও আবার এতদিন বাদে ঠিক সময়ে ধূমকেতুর মতন হাজির আমার বুতাই দা। মন প্রশ্ন করছে - বুতাই দা কি তাহলে আমার সিদ্ধিগুরু?


কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মন কে প্রস্তুত করে নিয়ে, বাড়ির সমস্ত মায়া কাটিয়ে বুতাই দার সাথে পাড়ি লাগালাম জঙ্গলমহলে বছরের শেষ কয়েকটা দিন কাটাতে। বুতাই দা, জঙ্গলমহলে একটা ছোট্ট ফার্ম হাউসে নিজের মনের মতন চাষ আবাদ করে। নিজের আর ফার্ম হাউস দেখভাল করার জন্য এক গোঁসাই কে রেখেছে। সেও বোধহয় বুতাই দাকে নিজের দীক্ষাগুরু মনে করে নিয়েছে!

কলকাতার আলো ঝলমল বর্ষবরণের উৎসবের মধ্যে সংসারের মায়া ত্যাগ করে জঙ্গলমহলের নিঝুম সন্ধ্যেতে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে যেন নিজেকে ই চিনতে পারছি না। ভোগ, বিলাস, সাফল্যের ইদুর দৌড়, সম্পর্কের ঘেরাটোপের হাতছানির মধ্যে জীবনের লক্ষ্য কে বেঁধে দেওয়া কতটা নির্বুদ্ধিতা সেটাই মেপে যাচ্ছি। নির্মেঘ সন্ধ্যার তারার মেলা তে নিজেকে হারিয়ে ফেলার আনন্দের কাছে সবকিছু গৌণ। দূর থেকে ভেসে আসা গোঁসাই এর কীর্তনের সুরে ভেসে চলেছি আমি।


বুতাই দার নিদান কি না জানি না, বৈষ্ণব গোঁসাই মনের আনন্দে আমাদের দেশি মুরগির ঝোল রেধে খাওয়ালো। শাক্ত বৈষ্ণবের এই রকম রূপান্তর দেখে আমি নিশ্চিত, ঠিক ঠাক একটা সাধু খুঁজে পেয়েছি আমি। আমার জীবনের পাল আমি এর হাতেই সঁপে দেব।


কব্জি ডুবিয়ে দেশি মুরগি গুলোর শ্রাদ্ধ শান্তি সম্পন্ন করে আমাকে শুভরাত্রি জানিয়ে বুতাই দা কোথায় যেন হাপিস হয়ে গেছে। কীর্তনের সুরও আর আসছে না। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নিস্তব্ধ রাতকে আরো স্থবির করে দিয়েছে। রাত বাড়ছে , ঠান্ডাও বাড়ছে।বাড়ি থেকে আসার সময় ব্যাগে একটা কম্বল নেবার সদুপদেশ কে আঙ্গুলের চুটকি দিয়ে সরিয়ে এসেছি। মনে মনে ভাবলাম, কাজটা বোধহয় ঠিক হয় নি আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল পুলিশ অফিসারের থেকে পাওয়া জ্ঞানের ঠুলি এখানেও প্রাসঙ্গিক!


ফার্ম হাউসের তক্তাপোষ এর উপর একটা চাদর শুধু। কোনো কোলবালিশ ও নেই! সারারাত এই ঠান্ডা সহ্য করা কি তাহলে সাধু হবার প্রথম পরীক্ষা? কারুর সাহায্য ছাড়া পরীক্ষা পাশ করা আমার সিলেবাসে নেই, কিন্তু আজকে কে আমাকে পাশ করাবে? যে পাশ করাতে পারতো সেই তো এখানে পরীক্ষক! মনকে প্রস্তুত করাচ্ছি, একটা রাতের তো ব্যাপার, ঠিক পারবো।


নাহ্, আর হলো না। সাধু হওয়া এই জীবনে আমার অধরাই থেকে গেল। সাধু হতে গেলে নিদেনপক্ষে কাল অব্দি বেঁচে থাকতে হবে। বিছানা থেকে নামার ক্ষমতা ঠান্ডার ছোবলে হারিয়ে গেছে। নিজের কানে নিজের গোঙানির আওয়াজ পাচ্ছি। যত সময় এগোচ্ছে সেই আওয়াজও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। নিজেকে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছি, ছোটবেলা থেকে শুনে আসা তেত্রিশ কোটি দেবতার কেউ নেই যে আমাকে কালকের সকাল টা দেখাবে?


চোখের দৃষ্টি চলে যাবার প্রায় শেষ মুহূর্তে ঘরের নুইয়ে পড়া আলোতে একটা খড়কুটো পাবার সম্ভাবনা দেখতে পেলাম মনে হলো। গোঁসাই এর গোপাল। একটা বড় দোলনার মতন কিছু ঝুলছে আর সেই দোলনার উপর গোপালের সংসার। গোপালের যাতে ঠান্ডা না লাগে, সেই জন্য দোলনার উপর কম্বল পাতা, আর গোপাল তার উপর বেশ একটা সাদা শাল জড়িয়ে বিশ্ব সংসারের সবার দায়িত্ব নিয়ে ঘুমোচ্ছেন।


শরীরের অবশিষ্ট সব শক্তি এক জায়গায় করে, বিছানা থেকে নেমে এক দৌঁড়ে গোপালের কম্বল ও শাল হাতে নিয়ে আমি কাঁপছি। বিবস্ত্র গোপালের কাছে হাত জোড় করে মিনতি, তোমার এই ঋণ আমি আমার জীবন থাকতে শোধ করে যাব।

কম্বলের গরমে প্রাণ ফিরে পাওয়া মাত্র দায়িত্বশীল সাংসারিক  মনে নতুন ভাবনা - বাড়ি ফিরে কি তাহলে গোপাল পূজো শুরু করতে হবে ঋনমুক্তির জন্য? সামান্য চায়ের কেটলির বদল চেয়ে যে ভাবে জ্ঞানের গুঁতো খেয়েছি, গোপাল পূজো শুরু করা মানে তো জ্ঞানের আগ্নেয়গিরির লাভা স্রোতে ভাসবো। তাহলে কি আর কোনো উপায় নেই?


মনের গোচরে ভেসে উঠছে সরু রূপালী আলোর আশা।


গোপাল মানে তো কৃষ্ণ আর রাম তো কৃষ্ণের ই এক রূপ। রাম পুজো করলেই তো তাহলে কৃষ্ণ পুজো করা হলো। নতুন ভারতের এখন সবচেয়ে সহজ ও সুবিধার কাজ হলো রাম নাম করা। মনটা খুশিতে ডগমগ। এ যাত্রায় সাধু না হতে পারলেও বর্তমান সব সমস্যার সমাধান। শুধু গলা খুলে একবার ডাক দাও - জয় রাম, জয় গোপাল।


-"Did you hear my covert narcissism I disguise as altruism.'


মেয়ের অযাচিত জ্ঞানের ভান্ডার থেকে খসে পড়া বিশ্ব বিখ্যাত এক গায়িকার গানের কথা, আমাকে ঋণমুক্ত করছে জঙ্গলমহলের নিশব্দ কুয়াশা পড়া শেষ রাতের এক ফালি চাঁদ কে সাথে করে।

Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page