top of page

ধূপ ধুনোর গল্প

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • Sep 20, 2020
  • 10 min read

- "আজকে চায়ের সাথে কি হচ্ছে?'

সন্ধ্যের চায়ের সাথে প্রায় রোজ ই নিত্য নতুন খাবারের স্বাদ পেতে পেতে মন টা বেশ লোভী হয়ে উঠেছে।  রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন মহাদেশীয় রান্না তে তিতলি মশগুল। সেই রান্নার ছবি আবার বন্ধুমহলে ঝড় ও তুলেছে। রান্নার উপর ভালোবাসা না কি নিজের সৃজনশীলতার প্রশংসা শুনতে চাওয়া কোনটা ঠিক আসল কারণ সেটা এখনো বুঝতে পারি নি। অষ্টাদশী মেয়েকে বোঝার মতন সময়ও তো দিতে পারি নি এতদিন!


সন্ধ্যেবেলাতে সবাই একসাথে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছি - এই সুন্দর ছবি টা কোনোদিন সম্পূর্ণ হতো না তিতলির উদ্যোগ ছাড়া। সকাল থেকে রাত অব্দি ল্যাপটপে মুখ গুজে থাকা একঘেয়ে জীবনেও যে আরো অন্য কোনো জীবন থাকতে পারে সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। লকডাউনের শেষ কবে হবে সেটা অনিশ্চিত। সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা তিতকুটে ভাব। নিজেকে উজ্জীবিত করার শক্তিও শেষের দিকে।


-"আজকে শুধু বিস্কুট । কিছু করতে ইচ্ছে করছে না বাবা'। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা তিতলির কথায় কোথাও যেন একটা বিষাদের সুর।

-"সব চলবে। তুই তাড়াতাড়ি চা নিয়ে আয়'।


এই সান্ধ্যকালীন চায়ের আসর আমাদের বাড়িতে বেশ এক পশলা বৃষ্টির আবেশ নিয়ে আসে।  সন্ধ্যের রাণী রাসমণি সিরিয়ালের টান ও ফিকে হয়ে গেছে আমাদের গল্পের আকর্ষণে। তিতলির হাতের মাফিন, ব্রাউনি, বেকড গার্লিক পটেটো ব্রেড ওর সত্তরোর্ধ ঠাকুমাকে নিশ্চিন্তে রেখেছে যে বিদেশ বিভূঁইয়ে তার নাতনি নিজের হাতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে। ঠাকুমার আবদারে বেশ কয়েকবার আলুর চপ আর ফুলুরি ও আমাদের আসর মাতিয়ে তুলেছে। রুনাই, মানে আমার পুত্র, বাড়িতেই দিদির সাথে "কলকাতা ফ্রায়েড ফিশ'  নাম টা ঠিক করে ফেলেছে, ভবিষ্যতের ব্যবসার। মানিক বাবুর "জন-অরণ্য' দেখে বাঙালি ব্যবসাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল কি না তা অবশ্য জানা নেই।


বেশিরভাগ দিন ই এই গল্প আসরের সূত্রধর তিতলির। আজকে কোথাও যেন একটা ছন্দপতন। শুধুমাত্র চায়ের চুমুকের আওয়াজ হলঘর জুড়ে থাকা নিস্তব্ধতা কে মাঝে মাঝে ভাঙার চেষ্টায়। তাহলে কি শুধু ওই খাবারের লোভেই গল্প আসরে নিজেকে হাজির করতাম? নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন টা হাতুড়ির এক একটা ঘা । নাহ্। আজকে আমি ই সূত্রধর হবো আমাদের সন্ধ্যে আসরের।


- "আজকে ম্যাডামের মুড টা ঠিক সুবিধের নয়, কি ব্যাপার সোশ্যাল মিডিয়াতে কি কিছু লাইক কম পড়িয়াছে?'

- "তোমার মনে হয় যে তোমার মেয়ে লাইক পাবার জন্য ছবি আপলোড করে?'

-"আর কি জন্য করে সেটা তো জানি না বাপু। তবে হ্যাঁ, নিজের অনুভূতি সবার সাথে ভাগ করে নেবার আনন্দ অবশ্যই থাকে কিন্তু ওই সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে নেবার দার্শনিক ভাবনা তো সময়ের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে, তাই একটু গুলিয়ে যাচ্ছে।'

-"কেন মেয়েটার পিছনে পড়েছিস বল তো? না রে দিদিমণি, বাবার কথা তে কান দিস না। ফেসবুক ছাড়া কোথায় আর আজকাল বন্ধুদের সাথে নিজের সুখ - দুঃখ ভাগ বাটোয়ারা করবি বল !'

-" উরিব্বাস ! কি সব বলছ গো মা ! তুমি তো দেখছি একদম ডিজিট্যাল ঠাম্মা হয়ে গেলে !'

-" সেটা আবার কি? ' - মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বড় মায়া লাগলো। মুখের ভাবটা ঠিক সেই ছোট্ট তিতলির মতন। অবাক চোখে রামায়ণের বিশল্যকরণী' র মানে বোঝার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।

-" মা তোমার মতন বুড়িয়ে যায় নি। ' -  সুযোগ পেলেই সেটাকে সদ্ব্যবহার করার অভিনব ক্ষমতাশালী নারীদের কে স্ত্রী বলা হয়।

-"যাহ বাবা, এর মধ্যে আমি আবার কোথার থেকে এলাম! ডিজিট্যাল এবং বয়স, এই দুটোর মধ্যে তো কোনো বিরোধ বা সম্পর্ক কোনোটাই নেই।'

-"ব্যস , শুরু হয়ে গেল। দিদি, তুই ই কিছু বল। সত্যি মা, তুমিও পারো।'

-"পুরুষের রক্ত যাবে কোথায়? বাবার হয়ে তুমি সালিশি গাইবে এর মধ্যে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।'

-"নাও, তোমরা ঝগড়া করো। সারাদিনে কথা তো বলো গুনে গুনে দশটা , তারমধ্যে সারাক্ষণ এই বুড়োদের মতন ঝগড়া করো, সত্যি বাবা ।'

-"দাদাভাই, এইটা একটু ভুল হয়ে গেল। বুড়ো হলে কিন্তু ঝগড়া ঝাটি কমতে থাকে। তোর দাদুর সাথে আমার ঝগড়া টা শেষ দিকে কিন্তু একদমই ছিল না।'


বাবা - মায়ের সম্পর্ক টা খুব অদ্ভুত ছিল। বন্ধু অন্তপ্রাণ বাবার জীবনে মায়ের ভূমিকা টা ঠিক কি ছিল সেটা কোনোদিন জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারি নি। অবসর জীবনে মা কি বাবার বন্ধু হতে পেরেছিল?


অন্যদিন এইরকম যুদ্ধ পরিস্থিতির সূচনা হলেই তিতলি ত্রাতার ভূমিকাতে নেমে পরে। আজকে অস্বাভাবিক ভাবে চুপচাপ। প্রেমে ঘা খেল না কি! নাহ্, এই প্রশ্ন সবার সামনে করা যাবে না। করলেই সপাটে উত্তর আসবে - " আর কবে একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হবে। ছেলে - মেয়ে বড় হচ্ছে। কথার আগল টা ঠিক হবে না তোমার কোনোদিন। গাধা পিটিয়ে কি কখনো ঘোড়া হয় ! " - নাহ্, শ্বাশুড়ীর সামনে বোধহয় এতটা নির্দয় আক্রমণ করবে না।


-" মন খারাপ? '

-" একজন কলেজে পড়া মেয়েকে জিজ্ঞাসা করছে, মন খারাপ! এর পরে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবে, মন খারাপের কারণ কি ? তাই তো ?" - কোন প্রশ্নের কিরকম উত্তর আসবে, আজকাল তার একটা বেশ ভালো ধারণা করতে পারি। নিজের সাফল্যে বেশ একটা ডগমগ ভাব। সাহানা র বিদ্রুপ গোলাপের পাপড়ি মনে হচ্ছে ।


-"আচ্ছা বাবা, "ধূপ - ধুনো' জেঠুর কোনো খবর জানো?' - তিতলির প্রশ্নে আজকের যুদ্ধবিরতি।

-" ধূপ - ধুনো জেঠুকে রে দিদি?'

-" তুই চিনবি না। দেখেছিস কিন্তু মনে নেই তোর। তুই খুব ছোট তখন। '

-" সে যেই হোক। নাম টা কিন্তু ঝাক্কাস। ধূপ - ধুনো জেঠু । ওটা কি তোর দেওয়া নাম? "

- "না না, ওটা পাড়া থেকে দেওয়া নাম। ' - অসিত দার নাম কাহিনীর কথা মনে পড়ে মুখের কোণে আনমনা হাসি।

-" বাবা, একটু বলো না , প্লিজ। এই রকম নাম টা হলো কি করে'?


রূনাইয়ের আবদারে অসিত দার গল্পে মেতে ওঠে আমাদের আসর।

ভালো নাম, অসিত মজুমদার। আমার ছোটবেলার সঙ্গী। বাবার থেকে শোনা, পূর্ববঙ্গ থেকে সব কিছু খুইয়ে আসা আরো অসংখ্য পরিবারের মতন অসিত দার বাবা টালিগঞ্জের উদ্বাস্তু শিবিরে অসিত দা কে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে বলেছিল - আমাকে ক্ষমা করিস। তোর জন্যে এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলাম কিন্তু সেই পৃথিবীর চাবি টা কেড়ে নিয়েছে ধর্ম , ক্ষমতা আর রাজনীতির খেলায় মত্ত, অন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ। যদি পারিস, নিজের হাতেই নিজের পৃথিবী গড়িস।


বাবা সরকারি উকিল। নাহ্, ফৌজদারি বড় মামলার উকিল ছিল না আমার বাবা। জমির বিবাদ, শরিকি ঝামেলা - মামুলি মামলার মধ্যবিত্ত বাঙালি উকিল। আলিপুর জর্জ কোর্ট - বাবার কর্মস্থল। ওখানেই বিমল জেঠু মানে অসিত দার বাবার একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। পূর্ববঙ্গের মানুষ হিসাবে বিমল জেঠুর উপর বাবার একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল। দ্যাশের লোক বলে কথা। বিমল জেঠুর মুখে বাঙাল ভাষার শোনার লোভে কি না জানি না, বেশ খানিক টা সময় বাবা ওই দোকানেই কাটাতো। ছোট্ট অসিত দা বাবার হাতে হাতে কাজ করেই নিজের পৃথিবী তৈরি করার পথে নেমে পড়েছিল পাঁচ বছর বয়েস থেকে। অসিত দার দুটি বিশেষ গুণ ছিল। একটি কে গুণ না বলে বৈশিষ্ট্য বলাই উপযুক্ত।


চায়ের দোকানের ধার বাকির হিসাব অসিত দা মুখে মুখে করতো। স্কুলে না গিয়েও কেউ মুখে মুখে এত সুন্দর অঙ্ক করতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাবা মাঝে মাঝেই আফসোস করতো, যদি এই ছেলে কে একটা ভালো স্কুলে পাঠানো যেত। চায়ের দোকানের পাশের পঞ্চা দাদুর আলু ঘুগনি দোকানের হিসাবের ভারও অসিত দার ছোট কাঁধে। সমস্যা শুধু একটাই। অসিত দার শুধু নাম গুলিয়ে যায়। মানে অনেক দিনের চেনা লোকের নাম ও বেমালুম ভুলে যায়। এই নাম ভুলে যাবার বড় খেসারত ও দিতে হলো একদিন।


পঞ্চা দাদুর দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিল ভবানীপুরের মুহুরি সাধন বাবু আর চেতলা 'র বাপির। নিয়মিত খদ্দের মানে ধারের খাতা চলে। বাপির আবার একটু সুনাম ও আছে প্রয়োজনে - অপ্রয়োজনে একটু বোমা - ফোমা বানানোর। সাধন বাবুর খাতাটা আবার একটু লম্বা আর মাসের শুরুর দিকেই খাতা টা একটু ছোট হয় , সেদিক থেকে বাপি অনেক নিয়মিত। মোটামুটি সপ্তাহ খানেক অন্তর খাতা পরিষ্কার করার একটা চেষ্টা করে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ, পূজো আসছে, পঞ্চা দাদু তার সব খদ্দের কেই অনুরোধ করে যদি পুজোর আগে ধার বাকি একটু মিটিয়ে দিতে পারে। দাদুর অনুরোধে, বাপি জিজ্ঞাসা করে কত টাকা বাকি আছে? প্রশ্ন টা স্বাভাবিক নিয়মেই অসিত দার কাছে এসে পড়ে। অসিত দা বাপির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে, কিছুতেই নাম মাথায় আসছে না। নাম না মনে করতে পারলে হিসাব টাও তো আসছে না। মাথার ভিতরে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলছে, চোখ পিট পিট করছে - কোনো ভাবে যদি নামটা মনে পড়ে। হটাৎ মনে হলো বাপি দার নাম হলো সাধন বাবু। ব্যস আর যায় কোথায় - সাধন বাবুর লম্বা খাতার ওজন পরলো বাপির উপর। তারপর যাকে বলে লঙ্কা কান্ড। উঠতি মস্তানের সাথে ওপর চালাকি। দাদুর আবার অগাধ বিশ্বাস অসিত দার উপর। অসিত কোনো ভুল করতে পারে না। প্রথমে অল্প বিস্তর কথা কাটাকাটি তারপর হুমকি - ভবিষ্যতে দাদু আর বিমল জেঠু কি ভাবে দোকান চালাতে পারে সেটা দেখে নেবে লম্বা জুলফি আর মুখে ক্ষুরের দাগের অধিকারী শিবু, বাপির ডান হাত।


বাবার কাছে শোনা , এই ঘটনার দিন সাতেকের মধ্যে রাতের অন্ধকারে পাশাপাশি দুটো দোকান ই ধূলিসাৎ । অসিত দার পৃথিবী গড়া থমকে গেল। বাবা ,বিমল জেঠুর দায়িত্ব লাঘব করার একটা প্রচেষ্টা স্বরূপ অসিত দা কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এল। অসিত দা তখন পনেরো, আমি তিন। আমাদের বাড়ির ফাই ফরমাস খাটা, বাজার হাট করা আর আমার ছোটবেলার দুষ্টুমির ঢাল - এই তিন পরিচয়েই অসিত দার আমাদের বাড়ির একজন হয়ে উঠলো। বিশ্বকর্মা পুজোর মাঞ্জা দেওয়া থেকে পাড়ার সরস্বতী পুজোর সময় সিগারেট হাতেখড়ি - সবই অসিত দার কাছে ।


বাবা, অসিত দা কে স্কুলে ভর্তি করার চেষ্টা করেছিল - কিন্তু কোনো স্কুলই পনেরোর কিশোরকে জায়গা দিতে পারে নি। বাবা খুব কষ্ট পেয়ে নিজেই অসিত দাকে অঙ্ক করাতে শুরু করে। এর বছর তিনেকের মধ্যে, অসিত দা এক রাতে হাসি মুখে নিজের কর্ম সংস্থানের খবর নিয়ে এল। গড়িয়াহাট ফুটপাথের দোকানে কর্মচারীর কাজ। বাবা খুশি হয়েছিল কি না জানতে পারি নি কোনো দিন, তবে বাধা দেয় নি।


যে নাম বিভ্রাট অসিত দার জীবনে প্রথম ঝড় এনেছিল, সেই নাম বিভ্রাট ই আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল গড়িয়াহাট ফুটপাথে । বিকিকিনির ভিড়ে ঠাসা ফুটপাথে অসিত দা যে কোনো মানুষ কে যে কোনো নামে ডাকতে শুরু করলো। অপরিচিত মানুষ গুলো নিজের নতুন নতুন নাম শুনে অপ্রস্তুত ও বিভ্রান্ত। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মানুষ গুলোর মধ্যে কিছু শতাংশ নিজের নাম টা ঠিক করার চেষ্টায় অসিত দার সাথে কথা শুরু করে , আর কিছু শতাংশ পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। প্রথম ভাগের কিছু মানুষ নিজেদের নাম টা ঠিক করতে সক্ষম ও হলো পরিবর্তে অসিত দার আলাপী ব্যবহারে ক্রেতাও হতে হলো। অসিত দা এটা বুঝে গেছে যে এই ফুটপাথের দোকানে একটা বিশেষ প্রবনতা আছে। যে দোকানে যত ভিড়, সেই দোকানে আরো বেশি করে লোক আসে। অতএব , দোকানের সামনে বেশ একটা সব সময় ভিড় করে রাখা প্রয়োজন।


সময়ের সাথে অসিত দার চাহিদা ঊর্ধ্বগামী। বড়ো দোকানের থেকেও ডাক আসছে। দু - বছরের মধ্যে অসিত দা বাঁধা দোকান থেকে নিজেকে মুক্ত করে একদম যাকে বলে  ফ্রিল্যান্স কনসালট্যান্ট। পুজোর সময় আর চৈত্র সেলের রেট দু থেকে চার গুণ। ওই ভিড়ের মধ্যে ই অসিত দা বৌদি কেও খুঁজে পেল। বিয়ের পর , আমাদের পাড়ায় একটা ছোট দু - কামরার ঘরে অসিত দার ভরা সংসার। সুখের সংসারে শুধু মাঝে মাঝে সন্দেহের দানা বাঁধে যখন অসিত দা বৌদি কে ওনার পৃত্তিদত্ত নাম ছেড়ে বিভিন্ন নামে ডাকতে শুরু করে। বৌদির আমূল বিশ্বাস, ওই নামে নিশ্চয়ই খুব কাছের কেউ আছে আর অসিত দা মনের অবচেতন মনে তাঁদের কে কাছে পেতে চায়। অসিত দা নিজের অসহয়তার কথা শুধু আমাকে শোনায়। এই বিদঘুটে সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান ও আমার মাথা থেকে বেরোয় না। নামের প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে দু - তিন বার কালীঘাটে পুজোও দেওয়া হলো, কিন্তু কোনো মুক্তি নেই এই প্রাদুর্ভাব থেকে। মা কালীর নিজেরই কত নাম ! কোন ভক্ত কোন নামে ডাকছে সেটার হিসেব রাখতেই উনি নিজে হিমসিম !


এর মধ্যেই অসিত দা এক জোড়া ফুলের বাবা হয়ে‌ আমাকে এসে বললো , বুবাই একটা জম্পেশ নাম ভেবে দিবি তোর ভাইপো দুটোর জন্য। এমন নাম ভাববি যেন আমি চেষ্টা করেও ভুলতে না পারি। নামের ওজন টা যেন একটু ভারী হয়। আমি তো বিপাকে। নামের ওজন তো কাজের দ্বারা হয়। অনেক ভেবে চিনতে ঠিক করলাম , একটু বড় আর খটমটে নাম দিতে হবে, তাহলেই বেশ ওজন বাড়বে। দিন সাতেক বাংলা অভিধান ঘেঁটে দুটি নাম ঠিক করলাম । ধূর্যটি প্রসাদ মজুমদার আর ধ্রুপদ নন্দন মজুমদার। মনে মনে বেশ খুশি হলাম, বেশ জমিয়ে রাখা গেছে, ইচ্ছে করলেও ভুলতে পারবে না। অসিত দাও বেশ একটা জমিদারি সুলভ নাম পেয়ে নিজের জীবনের অতৃপ্ত বাসনা গুলোর পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছে। কারুর জন্যে কিছু করতে পারার আনন্দ নিজের পাওয়া আনন্দের থেকে শতগুণে গভীর - জীবন দর্শনের এই শিক্ষাও ওই অসিত দার থেকেই।


সব সুখের দিনেরই বোধহয় একটা একসপেয়ারি ডেট থাকে । ছেলেদের স্কুলের দেবার বছর খানেকের মধ্যে জমিদার সুলভ নামের স্থায়ী রূপান্তর - অসিত মজুমদার এখন "ধূপ - ধুনোর" বাবা। বাঙালি আবার চিরকাল পূজো পার্বণ নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসে - অতএব "ধূপ - ধুনো"র গন্ধে আমাদের পাড়া ও বেশ ভালো ই সারা দিলো। অসিত দা করুণ মুখে কয়েকবার মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু এই রকম মুখরোচক নাম পেলে কি আর ছাড়া যায় !


-"ফাটাফাটি। ধূপ ধুনো জেঠু কে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে " - রূনাইয়ের চোখ চিকচিক করছে।


সত্যি তো কতদিন যোগাযোগ নেই। সুভাসগ্রামের দিকে জমি কিনে নিজের হাতে একটু একটু করে বাড়ি বানিয়ে অসিত দা যখন আমাদের পাড়া ছাড়লো, তখন ধূপ - ধুনো মাধ্যমিক দিয়েছে। তিতলি আট কি  নয়ে পা দিয়েছে। রোজ রাতে দোকান থেকে ফেরার পথে আমাদের বাড়িতে ধু মেরে  মায়ের হাতে এক কাপ চা খেয়ে তিতলির সাথে সারাদিনের গল্প শেষ করে তারপর বাড়ির পথ। কর্পোরেট জগতের নেশায় মত্ত আমি, তিতলি কে রোজ সময় দিতে না পারলেও ওর ধূপ - ধুনো জেঠুর কোনোদিন এর অন্যথা হয় নি। যে মানুষের নিজের পরিবারের জন্যে সময় নেই তার কাছে নিজের কাজের বাইরের কোনো মানুষের খবর থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ বারে বারে আসে না।


-"চল, কাল কে একবার গড়িয়াহাট বাজারে যাই। এখন পূজো আসছে, দূর থেকে যে দোকানে ভিড় সেখানেই তোর ধূপ - ধুনো জেঠু কে খুঁজে পাবো।'

-"না , আমি যাবো না। '

-"কেন রে? তুই তো অসিত দার কথা মনে করালি।'

-" আমি কাল গড়িয়াহাট দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। সব দোকান গুলো ফাঁকা। পুজোর আর একমাস ও নেই। জেঠুর মতন আরো অনেক গুলো মানুষ আবার করে পথে বসে গেল।'


তিতলির কথা তে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। গত সাত মাসে পৃথিবী টা কি রকম পাল্টে গেল।


-" তোর জেঠু নিশ্চিত কিছু একটা ব্যাবস্থা করে নিয়েছে। তুই চল না আমার সাথে, একবার ঘুরে আসতে তো দোষ নেই।'

-" না বাবা, তুমি রূনাই কে নিয়ে যাও। ও তো কোনো দিন দেখে নি ।'

-" রূনাই তো চিনতে পারবে না। তুই তাও চিনতে পারবি, অবশ্য জানি না , শেষ দশ বছরে অসিত দা কতটা পাল্টেছে।'

-"আমি চিনতে পারলেও যদি ধূপ - ধুনো জেঠু আমাকে চিনতে না পারে। কাবুলিওয়ালা গল্পে যদি কাবুলিওয়ালা মিনি কে চিনতে না পারতো তাহলে মিনির কষ্ট টা কি কেউ দেখতে পেত? ' - তিতলি চায়ের কাপ টা নিয়ে উঠে পড়েছে। আমাদের আড্ডার সমাপ্তির নির্দেশ এক বুক অভিমানের সুরে।


-"মেয়েদের কষ্ট বোঝার ক্ষমতা তোমাদের হয় নি ' - সুযোগের সদ্ব্যবহার ছাড়া নেই। সাহানা ও ডাইনিং টেবিল থেকে বাকি কাপ গুলো জড়ো করছে।

-"দিদিভাই, তোর ধূপ ধুনো জেঠু ভালো আছে"। আমাদের সবার মাথা মায়ের দিকে এক লয়ে ঘুরে গেছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটানো কৌতুহলী চার জোড়া চোখ আমার মায়ের দিকে।

-" তুমি কি করে জানো ঠাম্মা? তোমার সাথে যোগাযোগ আছে?'

- "ছিল না, নতুন করে এই কিছুদিন হলো।'

-"উফফ ঠাম্মা প্লিজ সাসপেন্স তৈরি করো না। ' - রূনাই- এর আর তর সইছে না। আমার ও!

- "দিদিভাই আমার মোবাইলে কি সব খুটুর - মুটুর করে দেখাল যে এখানে সব চেনাশোনা মানুষ কে খুঁজে পাওয়া যায়, ওখানেই তো পেলাম।'

- "মানে ? ফেসবুক?' । তিতলি বোঝার চেষ্টায়।

- " কি বলছ বলো তো মা ? তোমার আবার ফেসবুক?' - আমি কি রকম একটা বোধহীন অবস্থাতে ভাবলেশহীন মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে।

-"দিদিভাই আমাকে দেখাল কত চেনা শোনা মানুষ একটা জায়গা তে। সোমার পিসি, ঝিনাইয়ের ননদ, বাবুয়া সবাই কে দেখলাম ওখানে আছে। তুই , সাহানা সবাই তো আছিস দেখলাম। বুঝলাম এটাই বোধহয় এখনকার পাড়া। সবাই এখানেই গল্প করে। অনেক কে খুঁজে পেয়েছি জানিস? অসিত কেও পেলাম।"


মায়ের আবার সোডিয়াম পটাশিয়াম টা নেমে গেল কি না কে জানে! গতমাসে সোডিয়াম ব্যালান্স ঘেঁটে গিয়ে মা কি সব ভুল ভাল বকছিল। আমি কোনো কথা না বলে মোবাইল খুলে অসিত মজুমদার দিয়ে সার্চ করতে লেগে গেলাম। নাহ্, ফেসবুকের কোনো অসিত মজুমদার কেই আমার অসিত দা লাগছে না। নিশ্চিত মা ভুল ভাল কিছু করেছে।


-"তুমি ঠিক বলছ? আমি তো অসিত দা কে পেলাম না, এই তো দেখ।'

-"সে আমি জানি না বাপু। দিদিভাই আমার মোবাইলটা নিয়ে আয় তো আমার ঘর থেকে। অসিত রুবির হকার্স মার্কেটে একটা দোকান নিয়েছে। ধূপ - ধুনো ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে একজন ব্যাঙ্গালোর আর একজন ভিলাই। ভালো চাকরি করছে । পুজোর পর আমাদের বাড়িতে আসবে বলেছে' - মায়ের কথা গুলো এক কানে ঢুকছে আর চোখ অপেক্ষা করছে তিতলির আসার অপেক্ষায়।


সবার সামনে তিতলি মায়ের ফ্রেন্ডলিস্ট খুলছে। আমরা সবাই যেন সিনেমার ক্লাইম্যাক্স সিনে । অসিত দার এক গাল ভরা হাসি মুখ। নামের জায়গায় - "ধূপ ধুনো (অসিত)'।


তিতলি আর রূনাই ওদের ডিজিট্যাল ঠাম্মার নরম কুচকে যাওয়া চামড়া গালে গাল ঠেকিয়ে আদরে ব্যস্ত। আমার চোখের দৃষ্টি টা একটু একটু আবছা - জমে ওঠা জলটা সবার সামনে যেন বেরিয়ে না আসে। অসিত দার পৃথিবীর সেজে ওঠার আনন্দে , হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক খুঁজে পাবার উষ্ণতায় , পাশ থেকে শুনলাম - "আজ রাতে আমরা সবাই কি কন্টিনেন্টাল খাব? তোমরা গল্প করো। আমি আজ রান্না করছি'। সুযোগের সাথে সময়ের ভারসাম্য টা বজায় রাখার গুণ টাও জন্মগত।

Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page