নিউটনের উত্তরসূরি
- Abhijit Chakraborty
- Dec 16, 2023
- 5 min read

-"কি রে স্কুল যাবি না? কটা বাজে একবার খেয়াল করেছিস?'
সকাল থেকে এই নিয়ে তিনবার মায়ের ডাক শুনছে, আর প্রতিবার কোল বালিশটা কে আরো ভালো করে আঁকড়ে ধরে ঘুমের রেশ কে উপভোগ করার প্রাণপণ চেষ্টা। রিকু কিছুতেই আজ স্কুল যাবে না। প্রতিবাদ তো কোন একদিন শুরু করতেই হবে!
ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকেই রিকুর মধ্যে একটা বেশ বড় পরিবর্তন শুরু হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক বয়:সন্ধির পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক, এই নিয়ে পুলক বাবু, মানে রিকু'র বাবা কোনো দুশ্চিন্তার কারণ খুঁজে পান নি। কিন্তু, অনিন্দিতা, মানে রিকু'র মায়ের মনে কোথাও একটা কু-ডাক দিচ্ছে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে পরিবেশ টা রোজ একটু একটু করে গম্ভীর হতে শুরু করেছে। রোজ রাতে খাবার পর, বাবা, মা আর দাদার সাথে খুনসুটি করা বন্ধ হয়ে গেছে রিমির। দাদাকে নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে প্রায়ই কথা কাটাকাটি লক্ষ্য করছে। হঠাৎ করে এই রকম বাড়ির পরিবেশ পাল্টে যাওয়ার কারণটা কি সেটা জানার অনেক চেষ্টা করেছে রিমি, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। তিন বছরের বড় দাদা কে নিয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া ওর ভালো লাগে না।
-"কি রে আর কতবার ডাকতে হবে? রিমি, তোর বাবা কে বল, ওর গুণধর পুত্র কে ডেকে তুলতে'।
-"একদিন স্কুলে না গেলে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। রিমি, তোর মা কে বল, আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি স্নানে যাচ্ছি।'
পরের এক ঘণ্টায় ব্যানার্জি পরিবারে যা ঘটলো সেটাকে সুনামির ঢেউ বললে অত্যুক্তি হবে না। রিকু অনেকদিন ধরেই বোমাটা ফাটাবে বলে ভাবছিল। সে পরিষ্কার ভাবে বাবা-মা কে জানিয়ে দিল যে , সে শুধু আজকে নয়, এরপর থেকে আর কখনো স্কুলে যাবে না। কারণ জিজ্ঞাসা করে যেটা জানতে পারা গেল, সেটা নিয়ে রিমির দশ বছরের অপরিপক্ক মনে কি প্রভাব ফেলেছে সেটা বোঝা বেশ দুরুহ ব্যাপার।
নিউটন বাগানে বসে আপেল পড়া দেখেছিলেন এবং সেখান থেকে উনি ম্যাধাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কারের জন্য তো নিউটনকে স্কুলে যেতে হয় নি, শুধু চোখ কান খোলা রাখতে হয়েছিল। অতএব রিকু প্রত্যয়ের সাথে ঘোষণা করেছে, সে নিউটনের মতন শুধু চোখ কান খোলা রাখতে চায় এবং নতুন কিছু আবিস্কার করতে চায়। কলম্বাস থেকে নিউটন সবাই কোনো এক নতুন আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন আর রিকুও বিখ্যাত হতে চায়। বিখ্যাত হবার মূলমন্ত্র খুঁজে পাওয়া গেছে , তাই সময় নষ্ট করে স্কুলে যাবার পাত্র সে নয়। তারজন্য মহাভারতের যুদ্ধ হয়ে গেলেও হয়ে যাক।
দাদার যুক্তিতে ঠিক কতটা জোর আছে সেটা বোঝা না গেলেও, রিমি এটা খেয়াল করেছে যে বাবা-মা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা ভুলে গেছে। আর কোনো ভাববাচ্য তে কথা হচ্ছে না। দুজনেই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হতবাক হয়ে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষ ঠিক কতটা শোক পেলে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সেটার প্রমাণ খুব ছোট বয়সেই রিমি বুঝে গেল।
দাদার সাথে সেও এখন চোখ কান খোলা রেখে হটাৎ করে আপেল পড়ার মতন কিছু খুঁজবে আর সেখান থেকে নতুন একটা কিছু আবিস্কার হবে। উফফ্ কি মজার একটা খেলা দাদা খুঁজে দিয়েছে ওর জন্য। দাদাকে গলা জড়িয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছে রিমির।
সুনামির প্রথম ঝটকা টা কাটিয়ে নিয়ে, পুলক আর অনিন্দিতা নতুন উদ্দ্যমে ছেলেকে আবার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে জানতে পারলো যে শুধু রিকু না, দাদার জুড়িদার হয়ে দারুণ দিন কাটছে রিমির ও। মাঝে মধ্যেই রিকুর গলা শোনা যাচ্ছে, কি রে কিছু খুঁজে পেলি রিমি!
দেখতে দেখতে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হয়ে গেছে। রিকু এখন আর স্কুলে যায় না। স্কুল থেকে নোটিশ এসেছে , সাত দিনের মধ্যে রিকু স্কুলে না গেলে স্কুলের দরজা চিরদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। পুলক আর অনিন্দিতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যে করে হোক ছেলের এই অনিবার্য বিপর্যয় আটকাতে হবে। এরই মধ্যে পুলকের অফিসের এক চেনাশোনা সহকর্মী মারফত এক ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া গেল, যে নাকি এই রকম নানারকম কিম্ভুত বয়:সন্ধির সমস্যা সমাধান করাতে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু প্রথমদিন ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসার পরই অনিন্দিতা আপত্তি তুলেছে সমাধানের অন্য রাস্তা খুঁজতে হবে। মা হয়ে ছেলেকে পাগল সারানোর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর থেকে আত্মহত্যা করা অনেক সম্মানের।
হাতে আর মাত্র চার দিন। স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছে গিয়ে পুলক মুখ দেখাবে কি করে ? না কি সাহস করে বলতে পারবে - রিকু নিউটনের উত্তরসুরী এবং কিছুদিনের মধ্যেই রিকু বৈপ্লবিক এমন কিছু আবিস্কার করবে যার জন্য স্কুল গর্ব বোধ করতে পারে। তাই স্কুলের উচিৎ উত্তরসূরী কে নিজের মতন থাকতে দিয়ে আবিষ্কারে সহযোগিতা করা! যত সময় এগিয়ে আসছে, পুলকের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।
-"একটা কথা ভাবছিলাম। তুমি একবার জগাই দার সাথে কথা বলবে?'
-" তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? যার নিজেরই কোনো চাল চুলো নেই, সে না কি এই জটিল সমস্যার সমাধান করবে?' - পুলকের তীব্র প্রতিবাদ।
জগাই দা, পুলক দের পাড়ার এক পরিচিত নাম। পঞ্চাশ উর্ধ অকৃতদার। কলকাতা পুরসভার অস্থায়ী কর্মী। পাড়ার যে কোনো দরকারে প্রথম নামটা জগাই দা। কেউ ঠিক মতন জানেও না জগাই দা পুরসভার কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে! তবে সবাই জানে সকালে আর সন্ধ্যেতে নারু দা'র চায়ের দোকানে জগাই দাকে পাওয়া যাবেই। পুরসভার অন্দরমহলে ছেলের আবিষ্কার লুকিয়ে থাকবে না কি? অনিন্দিতার প্রস্তাব কে নাকচ করার পরও পুলকের মনটা খচখচ করতে থাকে! এখনো তো মিরাক্যাল হয়। পথের পাশে পড়ে থাকা পাথরে দেবতার জন্ম হয়, গণেশের দুধ খাওয়া শেষ হয় না - কত কিছুই তো চারিপাশে ঘটছে!
পরের দিন সকাল সকাল পুলক, জগাই দাকে রিকুর জীবনের আকস্মিক পরিবর্তনের কথা ও সংসারে নেমে আসা বিপর্যয় , পুরোটাই বিস্তারিত ভাবে বলে বুকের ভেতরে চেপে থাকা পাথর টাকে যেন একটু সরাতে পারলো। কোনো সমাধান হয়তো হবে না, কিন্তু ওই একটা কথা আছে না, ভাগ বাটোয়ারা করলে দুঃখের ভার একটু লাঘব হয় !
জগাই দা, মন দিয়ে পুলকের কথা শুনে খানিকক্ষণ উপরের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবলো আর তারপর নারু দা কে আরো দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো - "একটা কাজ কর, আজ রাতের দিকে রিকুকে নিয়ে আমার বাড়িতে আয়। আজকে দু-ঘণ্টা আর কালকে এক ঘন্টা আমি একটু রিকুর সাথে একা কাটাতে চাই। তবে একটা ব্যাপার, আমার সাথে রিকুর কি কথা হলো সেটা নিয়ে জানার চেষ্টা করলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।'
রাতের অন্ধকারে বাবা-ছেলে জগাই দার বাড়ি থেকে ফিরছে, ছেলে যেন কি রকম একটু অন্যমনস্ক আর বাবার পেটের ভেতর কৌতূহলের নাড়ি-ভুঁড়ি কিলবিল করছে, কিন্তু কোনো উপায় নেই ছেলেকে কিছু জিজ্ঞাসা করা। অনিন্দিতা রিকুকে খোঁচানোর চেষ্টা করছিল যদি কোনো ভাবে সন্ধ্যের ঘটনা জানা যায়। রিকুর মুখে কুলুপ। অনিন্দিতা একটু মৃদু আপত্তি তুলেছিল পরের দিনের জগাই দার কাছে যাওয়া নিয়ে। এবারের কারণ, ছেলে কাপালিকের হাতে পড়েছে বলে সন্দেহ। পুলক এবার আর আপত্তি কানে তোলে নি।
রাত সাড়ে নটা। পুলক জগাই দার বাড়ির সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে আর বারে বারে ঘড়ি দেখছে। এক ঘন্টা কথা বলার ছিল, এখন সেটা প্রায় দু-ঘণ্টা ছুঁই ছুঁই। ভিতরে কি হচ্ছে জানার জন্য প্রাণটা যেন প্রায় বেরিয়ে আসছে। আরো মিনিট পনেরো বাদে, জগাই দার বাড়ির দরজা খুলে রিকু বেরিয়ে আসছে আর তার পিছনে জগাই দা।
-"যা নিশ্চিন্তে বাড়ি যা'।
এই টুকু বলেই জগাই দা আবার বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। এই কথা টুকু যেন পুলকের চিন্তা আরো দু -গুন করে দিয়েছে। দমবন্ধ করা সাসপেন্স। শুধু বুকের ভিতর একটা ধুকপুকানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতেই অনিন্দিতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রিকুর উপর, আজ যে করে হোক ওকে রিকুর থেকে সমস্ত কথা জানতেই হবে। পুলকের সাবধানবাণী উপেক্ষা করেই।
-"মা, খিদে পেয়েছে খেতে দাও'। রিকুর গলা টা আজ একটু যেন অন্যরকম শোনাচ্ছে। সেই আগের রিকু কে ফিরে পেয়েছে মনে হচ্ছে।
-"কি হলো খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে'।
খেতে বসে, অনিন্দিতা যতবার জগাই দার প্রসঙ্গ তুলছে, ততবার রিকু সেই প্রসঙ্গ কাটিয়ে বোনের সাথে গল্পতে মশগুল। কিছুতেই রিকু কে বাগে আনা যাচ্ছে না। পুলক স্বান্তনা দেয় - আজকের রাতটা যেতে দাও, কালকে আমি দেখছি।
রিকুর চোখে ঘুম নেই আজ। বিগত দুদিনের জগাই দার সাথে কাটানো ঘণ্টা চার ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। জগাই দার বলা কথাগুলো শুধু কানে বাজছে।
-"এই পৃথিবীতে শুধু পাঁচটা ব্যাপার মৌলিক। আলো, বাতাস, আগুন, মাটি আর জল। খেয়াল করে দেখবি, আমাদের বাঁচার জন্য ঠিক এই পাঁচটা জিনিস লাগে আর অদ্ভুত ভাবে গাছেদের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। গাছেদের ও প্রাণ আছে, অথএব যে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব শুধু এই পাঁচটা জিনিস দিয়েই সম্ভব। এটা কিন্তু একটা আবিষ্কার। কিন্তু তোর এই আবিষ্কার কেউ মানবে না যতদিন তোর কাছে একটা পড়াশোনার সার্টিফিকেট আছে। তোকে এই আবিষ্কারের গোপন সূত্রটা জানিয়ে দিলাম, ব্যস তোকে আর আবিষ্কারের পেছনে ছুটতে হবে না। তবে এখন কাউকে এই নিয়ে কিছু বলিস না, বাচ্চা ছেলে বলে তোর কথা সবাই উড়িয়ে দেবে। কাল থেকে আবার স্কুল যাওয়া শুরু করে দে। পড়াশোনা করে যেদিন এই আবিষ্কারের কথা সবাইকে জানাবি দেখবি সেদিন তুই বিখ্যাত হয়ে গেছিস।'
সোনালী স্বপ্ন গুলো ভিড় করে এসে দাঁড়াচ্ছে রিকুর অবচেতন মনের দুয়ারে। নিউটনের উত্তরসূরি কে ঘিরে ক্যামেরার ঝলকানি, মিডিয়ার উত্তেজনা...নোবেল পুরস্কারের সম্বর্ধনায়...
Comments