প্রতিবিম্ব # ১
- Abhijit Chakraborty
- Mar 26, 2020
- 3 min read
Updated: Apr 6, 2020

রবিবারের দুপুর, ইলিশ ভরা পেট গুটিশুটি করে বিছানার দিকে এগোচ্ছে, হটাৎ করে বিপদের গন্ধ নাকে।
-'পুজোর শপিং টা কবে করবে?' - প্রমাদ গুনলাম। কানে আজকাল একটু কম শোনার সুবিধা নিতে হবে।
কড়িকাঠ ছাড়া ফলস সিলিং আমাকে ডাকছে।
পুজোর এক-দেড় মাস আগে থেকে সাজো সাজো রব। কটা জামা হবে তাঁর প্রতীক্ষায়। মা, মাসিরা কেনাকাটা করতে বেরোয়, কিন্তু আমাকে নিয়ে যায় না। আমি তো এখন বেশ বড় হয়ে গেছি, স্কুলে ফুলপ্যান্ট পরে যাই। ক্লাস সেভেন। তাও নিয়ে যায় না - আমার অভিমানের পাহাড় আমার হাইট ছাড়িয়ে গেছে। মিঠি, আমার মাসতুতো বোন, ক্লাস ফোর। ওর ও জায়গা হয় না গড়িয়াহাটের হকার দেখার। আমরা দুই ভাইবোন দুগ্গা ঠাকুরের খুব ভক্ত। তখনও রণে,বনে জঙ্গলের থেকে উদ্ধার করার মানুষের দেখা পাওয়া যায় নি। তাহলে কেউ কি আমাদের কে একটু পুজো বাজার দেখাতে নিয়ে যাবে না?
সন্ধ্যেবেলা তে মেসো এসেছে আমাদের বাড়ি। প্রস্তাব, আমাদের দুই-ভাই বোন কে নিয়ে সামনের রবিবার বিকেলে নিউ মার্কেটে পুজো মার্কেটিং। প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি! এর মধ্যে বলে রাখি, মেসো - আমার প্রথম আইডল। ময়দানের ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা এরিয়ানের প্রথম দলের গোলকিপার। বড় টিমে জায়গা হয় নি, কিন্তু বড় টিমের গাঁট বলে নামডাক কম হয় নি। ব্যাঙ্কের আন্যুয়াল ফাংশনের নাটকে মূল চরিত্র মেসোর জন্য সুরক্ষিত। বিয়ে বাড়ির তত্ত্ব সাজানো থেকে আড্ডার টেবিলে তুফান তোলা এক আকর্ষণীয় মানুষ কৈশোর হৃদয়ে ঝড় তুলবে এ আর নতুন কি কথা!
কেন জানি না, মা কিছুতেই রাজি নয় এই প্রস্তাবে। অভিমান এবার বারুদে ঠাসা বিদ্রোহের আকার নিচ্ছে। বাবাকে দিয়ে লর্ড কার্জনের নীতি প্রয়োগ করার সময়। রাতে শুতে যাবার সময় বুঝতে পারলাম, দুগ্গা ঠাকুর আর লর্ড কার্জনের আশীর্বাদ আমার আর মিঠির মাথায়। নিউ মার্কেটে কি এখনো সাহেব-মেম দের দেখা যাবে? ফেলুদার ডালমুটের দোকানটা দেখতে পাবো নিশ্চয়ই। ক্লাসে নিজের স্ট্যাটাস টাই পাল্টে যাবে - উফ্ফ।
তিনটে নাগাদ মেসোর আসার কথা। আজ সকালে খেলতেও যাই নি। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধুই নিউ মার্কেট আর এবারের পুজোতে নিজেকে কি ভাবে আমীর খান হয়ে ওঠা যায়। টেলিফোন তো ছিল না, তাই আশায় আশায় বসে আছি, কখন বাজবে কলিংবেল!
জীবনে পাওয়ার লোভ বেড়ে যাচ্ছে। বাসের জানলার ধারের সিট থেকে ট্যাক্সি। অচেনা জগত ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলছে চোখের সামনে। মিঠি বকবক করে যাচ্ছে মেসোর সাথে। আমি দু-চোখ দিয়ে গিলছি মনের উত্তেজনা কে। বিড়লা তারামণ্ডল, ভিক্টোরিয়া, রেস কোর্স, রেড রোড, দূরের ইডেন গার্ডেন, বড় টিমের ঘেরা মাঠ - মেসো আমাকে আমার ভবিষ্যতের সাথে পরিচয় করাচ্ছে।
গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলাম। উচ্চবিত্তের সুগন্ধী আর আভিজাত্যর মিশেল কে প্রথম দর্শন। ভিড়ে ঠাসা, বিকিকিনি তে ব্যস্ত শহর কলকাতা। আমিও সেই ভিড়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছি।মেসোর হাত শক্ত করে ধরলাম, অচেনা মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয়!
পরের দুঘন্টায় আমি আর মিঠি এত দিনের জমিয়ে রাখা মনের দুঃখ ভুলে সুদে আসলে নিজেরাই নিজেদের ড্রেস পছন্দ করে মিটিয়ে নিলাম। মোলায়েম মাখন জিন্সের সাথে ফুল হাতা কলার ওয়ালা গেঞ্জি। গেঞ্জি তখনও টি-শার্ট হয়ে ওঠে নি। তিনটে ফুলপ্যান্ট, দুটো টি-শার্ট আর একটা বোতাম দেওয়া জামা।
-'রেস্টুরেন্টে যাবি?'
আর কত বর পাব ভূতের রাজার থেকে? মিঠি আনন্দে মেসোর কোলে প্রায় লাফিয়ে উঠে পরে আর কি! একডালিয়া আর বালিগঞ্জ কালচারাল দেখতে গিয়ে গড়িয়াহাটের দাস কেবিন অব্দি আমার দৌড়, সেখানে সাহেবি পাড়ার রেস্টুরেন্ট!
'বাদশা' - নামটার মধ্যেই কেমন যেন একটা রাজকীয় ভাব। কাঁচের দরজা ঠেলার আগেই একজন দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে হাসি মুখে। দেখে মনে হলো মেসোর অনেকদিনের চেনা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতেই একটা তীব্র অচেনা গন্ধ নাকে লাগল। অনেক গুলো টেবিল, কোনটায় দুটো, কোনটায় চারটে চেয়ার। আমি আর মিঠি ছাড়া আমাদের বয়সী কাউকেই দেখতে পেলাম না। আলো আঁধারী পরিবেশে সবাই বেশ চেঁচিয়ে কথা বলছে।
-'কি খাবি'?
- 'মোগলাই পরোটা।' - মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্তই।
রেস্টুরেন্ট দেখা শেষ। পেটও ভর্তি কাবাব আর গোল্ড স্পটে। এবার বাড়ি যাবার জন্য মন আনচান করছে। যত সময় যাচ্ছে, মেসো কেমন যেন এক অচেনা মানুষ হয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি বেশি করে হাসছে আর বার বার জিজ্ঞাসা করছে যে আমার ভয় করছে কি না। মেসোর থেকে ময়দানের গল্প শুনছিলাম, কিন্তু গল্পটা কিছুতে শেষ হচ্ছে না। মেসোর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে - গল্প শোনার আগ্রহটাই নষ্ট। মেসোর ঘড়ি বলছে প্রায় সাড়ে আটটা। আমি বাড়ি যেতে চাই। মায়ের কাছে যাব। কিন্তু অচেনা মেসো কে নিজের মনের কথা বলার সাহস নেই। আমাদের বসতে বলে মেসো টয়লেট গেছে। এর আগেও দুবার মেসো টয়লেট গেছিল কেমন একটা দুলতে দুলতে। বিকেলেও তো হাঁটা টা স্বাভাবিক ছিল। মিঠি একমনে নতুন কিনে দেওয়া খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। আমি কেন তাহলে এত ভয় পাচ্ছি? প্রায় অনেকক্ষন হয়ে গেছে,মেসো ফিরছে না। চোখ ফেটে জল বেরোবে বেরোবে করছে। আমি বাড়ি যাব।
-'ভাবছি, এবার শপিংটা অন-লাইনে করে নি। ওই গরমে ভিড়ের থেকে অনেক শান্তি করে পছন্দ করা যায়। শুধু শাড়ীটা কিনতে একবার বেরোবো।'
নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে দেখলাম, ঠিক শুনছি তো? নিম্নচাপ আর ঝড়টা ঠিক লাস্ট মোমেন্টে বাংলাদেশের দিকে চলে গেল।
-'শেষ দুপুরে ঘুমোতে যাচ্ছ, তাড়াতাড়ি উঠো কিন্তু। সন্ধ্যেতে মহুয়াদের বাড়িতে আবার পার্টি আছে। তুমি আজও যদি বাড়াবাড়ি কর তাহলে এর পর থেকে আমাকে আর কোথাও যেতে বলো না। ছেলে বড় হচ্ছে, এটা একটু খেয়াল রেখো।'
Comments