প্রতিবিম্ব # ৪
- Abhijit Chakraborty
- Apr 1, 2020
- 5 min read

সেন্ট্রাল এভিনিউতে গাড়ি আর নড়তে চাইছে না। স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত মন ও পড়ে আছে কুমারটুলীর রাতে।
মা ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে লরি ছেড়েছে মিনিট কুড়ি। আমার দায়িত্ব, সরস্বতীকে চোখে চোখে রাখা। বাবু দা, লরির ছাদে। হাতে লম্বা বাঁশের আকশি। টেলিফোনের তার সরিয়ে মায়ের আগমনের রাস্তা সুগম করতে ব্যস্ত। মেসো ছাদে ওঠার বায়না শুরু করেছিল। আমি লরির কেবিনে চালান করে দিয়েছি। সবার চোখে আমার ব্যাপারে সম্ভ্রম ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। আজ আমি হিরো।
শোভাবাজার ক্রস করে কিছুদূর যাবার পর,লরি বাঁ দিক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনের রাস্তা তো ফাঁকা! চাকা পাংচার হলো নাকি? বুম্বাদা, বাবু দা ও আরো কয়েক পাড়াতুতো দাদা-কাকু ধুপধাপ লরি থেকে নেমে পড়ে রাস্তা পার করে উলটো দিকের একটা বড় গলির দিকে যাচ্ছে। দু-তিন মিনিটের মধ্যে অনুসন্ধানী মন জেনে গেল, এটা ঠাকুরের চালচিত্র কেনার স্টপেজ। পুজোর শাড়ি কেনার পর মানান সই ব্লাউজ ও তো চাই!
লরির প্রায় আর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেছে। আমার মতন দু-চারটে নতুন মুখ এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। প্রথমবার ঠাকুর আনতে আসা, সব অভিজ্ঞতা চেটেপুটে নিতে হবে। আমিও নামলাম। কেবিনে উঁকি দিলাম ছোট্ট করে। মেসো অকাতরে ঘুমাচ্ছে। যাক শান্তি! আমিও রাস্তা পার করে বাবু'দা দের পিছু নিলাম।
মেথরপট্টি। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন।কলকাতার কত অজানা জায়গা ও শিল্প সৃষ্টির মাতৃগর্ভের সাথে পরিচয় হচ্ছে। কয়েক শো মানুষ কারখানার শিফটের মতন চোখ ধাঁধানো চালচিত্র তৈরি করে যাচ্ছে। বাদল জেঠু আমাদের পাড়ার নামি ভাস্কর। আজ বাদল জেঠুর কিছুতেই ঠিক রেডিমেড চালচিত্র গুলো পছন্দ হচ্ছে না। অবশেষে একটা সেট পছন্দ হলো, কিন্তু কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। বাদল জেঠুর তত্ত্বাবধানে শিল্পীরা কাজ শুরু করল। আমাদের দলের বাকিরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। বুঝলাম এক ঘন্টার বিরতি - 'যেমন খুশি ঘোরো'।
মধ্যবিত্ত পাড়ার মেধাবী ভালো ছেলে আমি।ভবিষ্যতের ডাক্তার। তাঁর উপরে আজকের সন্ধ্যের মুশকিল আসান করা ফকির, আমাকে সবাই বেশ আগলে আগলে রাখছে।
- "একটা নতুন জায়গা দেখবি ? "
শুভ দা'র তেঁতুল পচা নিঃস্বাস আমার কানের লতি ছুঁয়েছে। শুভ দা, আমার থেকে বছর তিনেক বড়। পড়াশোনার পাট অনেকদিন হলো বিদায় নিয়েছে। আমাদের পাড়ার পিছনের বস্তিতে আগাছার মতন বেড়ে ওঠা উঠতি মস্তান বলে পরিচিত একটা নাম। রাতে বিরেতে হসপিটাল থেকে শ্মশান - যে কোনো সমাজসেবা তে নিবেদিত প্রাণ।
মনের দোটানাকে সরিয়ে কলকাতার আরো এক নতুন জায়গা দেখার কৌতূহলে আমি শুভ দা'র সাথে পা মিলিয়েছি। মেথরপট্টি কে পিছনে ফেলে রেখে বেশ কিছু থমথমে অন্ধকার গলির পাহারাদার কুকুরের ডাকের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। কুকুর নিয়ে এমনিতেই আমার একটা অজানা ভয় কাজ করে। কৌতুহল টা কন্ট্রোল করা উচিত ছিল।
আরো মিনিট দশেক এ-গলি ও-গলি ছাড়িয়ে দূর থেকে অল্প বিস্তর কিছু মানুষ দেখতে পাচ্ছি। শুভ দা'র চোখের ইঙ্গিতে বুঝলাম গন্তব্যের খুব কাছাকাছি। একশ মিটার হাঁটতেই দিনের আলোর মতন পরিষ্কার কলকাতার নতুন জায়গা। মেডিকেলে পড়ার সময়ই নাম শুনেছি। এই তাহলে সেই জায়গা। মা-বাবা জানতে পারলে কি হবে!
-"চালচিত্র রেডি হয়ে গেছে এতক্ষনে। চলো ব্যাক করি।"
ভালো ছেলেকে খারাপ করার এই রকম সুযোগ সবসময় আসে না। কোনো ভাবেই এই পরে পাওয়া চোদ্দো আনা হাতছাড়া করার চান্স কেউ ছাড়ে! শুভ দা আমার হাতটা চেপে ধরেছে। বজ্র আটুনি। শক্তিতে পারব না। নিয়ন আলোর নিচে ব্যস্ত কলকাতার রঙিন বিকিকিনির মধ্যে আমি মিশে যাচ্ছি। খোলা পিঠ, বুকের আঁচল ভেদ করে ওঠা উদ্ভিন্ন যৌবন। সঙ্গে দোসর - উন্মুক্ত নাভির গভীর হাতছানি। সস্তা সাজের গাঢ় রঙের ঠোঁট কামড়ানো ডাক পৃথিবীর আদিম রহস্যের মায়াজালে আমাকে টানছে। আমি হেরে যাচ্ছি আমার কাছে। কি করে মুখ দেখাব পৌষানীর কাছে!
-"কেউ জানতে পারবে না। আধ ঘন্টার ব্যাপার।" - শুভ দা'র হিসহিসে ছোবল আমাকে এক নিমেষে খারাপ করে দেবে।
নাহ, আমাকে শক্ত থাকতেই হবে। মা-বাবার জন্য, পৌষানীর জন্য। আমার ভালত্বের জন্য।
-"কি টুকটুকে বাচ্চা। লজ্জা লাগছে?" - অভিমন্যুর চক্রবুহ্যে আমি । খিলখিল করছে আমার চারিপাশ। শুভ দা'র বজ্র আটুনি খুলে গেছে। পরিবর্তে কাঁচের চুরির হাতের শিকলের টানাটানি। উগ্র সেন্ট মাখানো শরীরের গন্ধ অবশ করে দিচ্ছে ভালো আর খারাপের মধ্যেকার অনুভূতি কে। শুভ দা'র থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
একটা ভিড় দূর থেকে এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে। চিৎকার ও একটা ভয়ার্ত গন্ডগোল। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। ব্যস্ত কোলাহল গলিতে একটা অস্থিরতা। দুটো রক্তাত্ব ছেলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। পেছনে উন্মত্ত জনতা। মেয়েটি আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে একটা বাড়ির দরজার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। এই সুযোগ চক্রব্যুহ থেকে পালানোর। আমি ছুটতে শুরু করলাম। আমার পেছনে ছেলে দুটো। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। সামনে দেখি পুলিশের দল।
তীব্র গা গোলানো গন্ধে বমি আসছে। খারাপ হবার চেকলিস্টে টিক পরার দিন আজ। টিমটিমে জ্বলা বাল্বের আলোতে সবার মুখটাও পরিস্কার নয়। গারদের ভেতরে থাকা মানুষগুলোকে দেখতেও চাইছি না। লোকগুলোর ভাষায় নতুন করে বাংলা ভাষার সাথে আমার পরিচয় হচ্ছে। আর কোনো নতুন কিছু দেখতে চাই না, শুনতে চাই না। শুধু বাড়ি যেতে চাই।
হাতে পায়ে ধরেছি, নিজেকে হবু ডাক্তার বলে পরিচয় দিয়েছি - তাতেও ভবী ভোলার নয়। বড় বাবু এখনো থানায় আসেন নি। হবু ডাক্তার হবার পরিচয় পেয়ে আপাত শান্ত সৌরভ শুক্লা'র ডুপ্লিকেট মেজো বাবুর মুখের ভাষা আর মেজাজ দুটোই আরো বিগড়ে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা বলছে রবিবার হতে আর মিনিট পনেরো বাকি। হাজতবাস বা বন্ডে সাইন করে বেরোনোর জন্যও নাকি সোমবার সকাল ১১টা অব্দি আমার ঠিকানা এই বুড়োতলা থানা। প্রাকৃতিক কর্ম ও ওই কুড়ি ফুট বাই পঁচিশ ফুটের আস্তানার কোনের চট দিয়ে ঘেরা অংশে।
বংশের মুখ উজ্জ্বল করে সোমবার আমি কোর্টে চালান হবো। পৌষানী আমাকে বরমালা পরিয়ে জেল থেকে বাড়ি নিয়ে ওর বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করাবে। কলেজে প্রফেসররা আমাকে গার্ড অফ অনার দেবে। পাড়ার পুজোতে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে আমার ভালো মেধাবী ছেলে থেকে পতিতালয় থেকে ধৃত আসামি হবার উত্তরণের জন্য। আমার জীবনের মোড় ঘুরে যাবার দিনটায় কার মুখ দেখে উঠেছি ভাবার চেষ্ঠা করছি। মাথাটা ঘুরছে। কোনক্রমে গারদের লোহার গরাদ টা ধরে আছি। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে বুঝতে পারছি। ডিহাইড্রেশন, টেনশন - চোখটা উল্টে যাবে যাবে। মনে হলো একটা চেনা গলা দূর থেকে ভেসে আসছে।
-"স্যার, বোনপো কে তো আমার ছাড়িয়ে নিয়ে যেতেই হবে।"
-"হ্যাঁ যাবেন। সোমবার, বেল দিয়ে।"
-" বোনকে কথা দিয়ে এসেছি, আমি ওর খেয়াল রাখবো। কথার খেলাপ তো আমি করতে পারব না।"
-"এটা তো নাটকের মঞ্চ নয়, গিরিশ বাবু" - মেজো বাবুর রসিক পরিচয় পেয়ে আমার মনে একটা ক্ষীণ আশা জাগছে। মেসোর সাথে বাদল জেঠু, বুম্বা দা, বাবু দা। সাথে আরো জনা সাতেক পাড়াতুতো দাদা-কাকা। একদম পেছনে শুভ দা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
থানার সবাই মেজো বাবু আর গিরিশ ঘোষের নাটক থেকে চোখ নড়াতে পারছে না। দিনরাত চোর-ডাকাত-খুনীদের কে সামলানোর পর বিনা টিকিটে এই রকম নাটক দেখার লোভ সামলানো কঠিন। আমার শরীরে নতুন করে আবার সাহস খুঁজে পাচ্ছি। রাতের শেষে ভোর হবার মতন , বাড়ি ফেরার একটা আলো দেখতে পাচ্ছি।
-"স্যার, আমি আপনাকে এবার এমন একটা অফার করব, আপনি না বলতেন পারবেন না।" - মেসোর চোখ টা আমি গারদ থেকে না দেখতে পেলেও কল্পনাশক্তিতে ভর করে বুঝতে পারছি। মাছ, চারা টা গেলার অপেক্ষায়।
-"মানে? থানায় বসে পুলিশকে আপনি ঘুষ অফার করছেন?"
'মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন' - মেসোর জলদ গম্ভীর গলায় থানার পরিবেশটা দক্ষিনেশ্বর কেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। মেজো বাবুর মুখের ভাবটা মনে হচ্ছে যেন ঠাকুর আজ মায়ের দেখা পেল।
চালচিত্র নিয়ে লরি পাড়ার মুখে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। শিউলির গন্ধে শরতের ভোরকে আমার আজ আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে। বাকি রাস্তায়, মেসো আমাকে আর চোখের ছাড়া করে নি।
-"তুমি হঠাৎ গান গাইলে কেন মেসো? তোমার তো অনেক চেনা পুলিশে আছে, তাঁদের কে ফোন করলে ই তো হতো"
-" শেষ অস্ত্র তো ছিলই। আসলে কি জানিস, মেজো বাবুর চোখটা দেখে মনে হলো উনি অনেক দিন ধরে কোনো মানসিক কষ্ট পাচ্ছে। দেখলি না, গান শুনে ওনার চোখটা কেমন ছলছল করে উঠল।"
-"এবার কোন দিকে যাব?" - সম্বিৎ ফিরে পেলাম ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথায়। ভুলে গিয়েছিলাম হলুদ ট্যাক্সি তো আমার বাড়ি চেনে না। রাস্তাটা বলে খেয়াল করলাম আমার চোখটাও যেন ভিজে ভিজে। কার জন্য, আমার না মেসোর জন্য?
Comments