top of page

ভূত চতুর্দশী

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • Mar 26, 2020
  • 8 min read

প্রায় বছর তিরিশ ধরে দর কষাকষি'র পর রাজী করাতে পারা টা একটা জীবনের ফলক বলে মনে হচ্ছে তীর্থের। তীর্থ আর আর্য্য, গল্পের দুই চরিত্র। খুব সংক্ষেপে দুজনের সম্বন্ধে বলে নেওয়া ভালো। এখন হলো চট করে বুঝে নেওয়ার যুগ। মোদ্দা কথাটা বোঝা নিয়ে দরকার। তীর্থ আর আর্য্য - দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব প্রায় দুই কুড়ি পেরিয়ে গেছে। সেই কি যেন বলে, ল্যাংটো বয়স থেকে বেড়ে ওঠাএক সাথে, এক পাড়ায়। অর্থনৈতিক দিক থেকে নিজের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আর্য্য সোনার চামচ মুখে করে জন্মেছে আর বড় হয়েছে। তীর্থ, সরকারি চাকরি করা, মাসে এক রবিবার মাটন খাওয়া পরিবারের। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে ওদের ভাবনা চিন্তা একদম আলাদা হওয়া সত্ত্বেও ওদের বন্ধুত্ব চির সবুজ। যাই হোক মোদ্দা কথা হলো - এত কাছের সম্পর্ক রেখেও এত দিন ধরে একটা ব্যাপারে আর্য্য রাজী হয় নি, সেটা হলো ভূত চতুর্দশীর রাতে ভূত দেখতে যাওয়া। ভূত কে ঠিক ভয় নয় কিন্তু ভূত নিয়ে আদিখ্যেতা ব্যাপারটা পোষায় না। হটাৎ কি মনে হলো গত শনিবারের সাপ্তাহিক নেশাতুর অবস্থা তে আর্য্য রাজী হয়ে গেল। প্রতি বছর ভূত চতুর্দশীর আগে তীর্থের অনুনয়, বিনয়, সম্পর্ক নিয়ে ইমোশোনাল সুড়সুড়ি - কোনোটাই ফল দেয় না। আর এই নিয়ে কালীপুজোর দিন এবং তাঁর পরের কিছু দিন মান-অভিমান পর্ব চলে। ভালোবাসার সম্পর্কে মান অভিমান আর সুখেন দাসের সিনেমায় মৃত্যুদৃশ্যর মধ্যে মিল খুঁজে না পাওয়া একটি ক্ষমাহীন অপরাধ। বাঙালীর ধার্মিক, সামাজিক আর সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত নেশা করার দিন, মানে কালী পুজোর দিনে দু-বন্ধু একসাথে বসে কোনো দিন নেশা করা হয় নি - এই অনুতাপে আর্য্য এবছর ওর এত দিনের রণেভঙ্গ দিয়েছে কি না তাঁর কোন প্রমাণ নেই। তীর্থের বিশ্বাস ছিল , কোনো দিন না কোনো দিন রাজি করাবেই। -"এই বছর শনিবার পড়েছে ভূত চতুর্দশী। ভুতেদের বাৎসরিক সম্মেলনের উন্মাদনা ও এবার বেশি। ওদের জগতেও শুভদিন, শুভলগ্ন বলে ব্যাপার আছে। ওদের ও জীবনে আশা-ভালোবাসা আছে।" -"উফ্ফ ওদের আবার জীবন কোথায়?" -"ওই হলো। ঠিক আছে, ওদের জীবন নেই, সমাজ আছে।" - তীর্থ সব মেনে নেবে, যা আর্য্য বলবে। ভুতেদের নিয়ে অত লজিক্যাল হলে ভুতেদের সাথে কথা বলা যায় না। আজকের দিনে যে ভূতেদের সাথে কথা বলা যায়, ওদের ছোট ছোট অনুভূতির কথা শোনা যায় সেটা অবশ্য বলে নি। এই সব অযৌক্তিক কথা বললে আরো বছর কুড়ি লেগে যেত আজকের দিনটা দেখতে। ভবানীপুর কবরস্থান আর আলিপুর জেলের সংলগ্ন জায়গাটা বেশ পরিচিত ভুতেদের সম্মেলনের ব্যাপারে। প্রায় বছর তীর্থ আসে এখানে। এ ছাড়াও গড়ের মাঠ, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, শিবপুর ঘাট মাঝের বছর গুলোও সিলেক্ট করে সম্মেলন দেখতে যাবার জন্য। এটাও ওই বড় দুর্গাপূজা দেখতে যাবার মতন। একটাই বড় পাওনা, ওদের সম্মেলন কোনো রাজনৈতিক ভূত দাদা বা দিদি অর্গানাইজ করে না। বেশ পুরোনো পাড়ার বারোয়ারী পুজোর স্বাদ পাওয়া যায়। এত আপন করে নেয় যে মনে হয় কতদিনের চেনা। ভুতেদের সাথে কথা বলে জেনেছে যে মড়ার পর জাগতিক টান না কাটানোর শাস্তি স্বরূপ ওদের এই ভূত জীবন। ভূত জীবন কাটানোর পর তারপর স্বর্গের বা নরকের দরজা। আঙ্গুর খেতে খেতে উর্বশীর নাচ দেখার আগে গত ঝক্কি। এই ভূত চতুর্দশী রাতে মানুষের সাথে কথা বলে নিজেদের অবশিষ্ট জাগতিক লালসার কথা স্বীকার করতে পারলে নম্বর পাওয়া যায়। শাস্তি মুকুব হতে একটা মিনিমাম মার্কস লাগে। কিছু ভূত আছে যাঁরা এই ভূত সমাজটা ছেড়ে যেতে চায় না। ওই ভূত গুলোর থেকে কথা বাড় করা খুব মুস্কিল। কয়েকবার এই রকম এক ভূতকে তীর্থ খুঁজে বার করেছিল যার বয়স প্রায় বছর চারশো! ওকে তীর্থ জিজ্ঞাসা করেছিল - "আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ও কি ভূত হিসাবে এসেছিলেন? " সমাজের ঢোকার প্রথম দিন নাম প্রকাশের গোপনীয়তা রক্ষার অঙ্গীকার বদ্ধ হতে হয় ভুতেদের। ওদের সমাজের নিয়মের কথা বলাতে আপত্তি নেই। বেশ নিয়মবদ্ধ সমাজ। ভূত সরকারের নিয়ন্ত্রণ বামপন্থী ভূতের হাতে কি না সেটা এখনো জানতে পারে নি।  এই প্রশ্নটা করতে সাহস হয় নি, যদি ঘাড় মটকে দেয়। প্রতি বছর সম্মেলনে এসে বেশ কিছু নিয়মের কথা জেনে গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ভূত ই ওর সাথে গল্প করার সময় নিজেদের নম্বর তোলাতে ব্যস্ত থাকে। আরে বাবা, ভূত বলে কি স্বার্থ থাকবে না? সমস্যা টা হলো, ভুতেদের বিভিন্ন নিয়মের কথা আর ভূতের সাথে কথা বলার ব্যাপারটা না জানলে তো আর্য্য তো এই সন্ন্মেলনে আসার আনন্দটা ই পাবে না। গোপালনগর থেকে ভবানীভবন কে ডাইনে রেখে আলিপুর জেলখানার পাশ দিয়ে হেঁটে ভবানীপুর কবরস্থানে যাওয়ার সময়ই আর্য্যকে একটু প্রিপেয়ার করে দিতে হবে। -"ইয়ার্কি হচ্ছে? ভুতেদের কথা শোনানোর জন্য তুই আমাকে কবরস্থানে নিয়ে যাচ্ছিস?"  উত্তেজিত আর্য্য। -"এখানে কেন চিৎকার করছিস? দেখছিস না, পুলিশ গুলো কি রকম ভাবে দেখছে? পুলিশ কমিশনারের বাড়ির সামনেই তোর এই রকম চিৎকার করতে হবে?" কত পয়সা খরচ হলো, সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের আর বন্ধু হয়ে ওঠা হলো না। তীর্থ মানুষের দুর্বলতা খুঁজে নিতে বেশ পারদর্শী। বাধ্য ছাত্রের মতন ভূত-ভাঠালি শুনে যাচ্ছে। বাকি রাস্তাটা তীর্থ লজিক্যালি বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ওর কথা বিশ্বাস করলে আর্য্য নিজের ডিসিশনের একটা যথার্থতা দিতে পারবে। বাঙালি বাড় খায় না , এটা তো হতে পারে না। কবরস্থানের গেটের কাছে পৌঁছতেই কি রকম একটা অস্বস্তি হতে শুরু হয়েছে আর্য্যের। একটু একটু করে ঘাম দিচ্ছে। অন্যদিকে তীর্থের মুখ ভীষণ উজ্জ্বল। - "কি রে ভয় লাগছে নাকি ?" -"না , একটা কি রকম অন্য রকম লাগছে। ঠিক বোঝাতে পারব না। শুধু মনে হচ্ছে কানের পাশে একটা গরম হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।" -"হমম। বুঝতে পেরেছি। কালীঘাটের মন্দিরে যেমন পান্ডা গুলো ছেঁকে ধরে, এখানেও সেই রকম ভূতেরা মানুষ খোঁজে নম্বর তোলার জন্য। একটু খেয়াল করলে হয়তো বুঝতে পারতিস, ওরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিল। " বেরোনোর আগে দুজনেই কয়েক পাত্র চড়িয়ে বেরিয়েছে কিন্তু বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পায় নি যে এই রকম মনগড়া কথা শুনতে হবে। আর্য্য চরম বিরক্তিতে মাথা নাড়তে শুরু করেছে। অদ্ভুতভাবে একটা অমোঘ আকর্ষণ কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ফিরে যেতে পারছে না। তীর্থের সাথে কবরস্থানের সামনের গেটের চৌকিদারের কথোকপঠন যেন অনেকদিনের পরিচিত দুই বন্ধুর। বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দেবার সময় এটাও জানাতে ভুললো না , যে ছোটবেলার বন্ধু প্রথমবার আসছে কবরখানা তে আর তাও ভূত চতুর্দশী রাতে। খয়েরি ছোপ পড়া ফোকলা দাঁতের হাসি টা কি রকম ঘিনঘিনে লাগলো আর্য্যের। আশ্চর্য ভাবে আলাপের সময়ও কোনো গলার আওয়াজ পাওয়া গেল না চৌকিদারের কাছ থেকে। অস্বস্তি টা আরো বাড়তে লাগলো। গেটটা ছাড়াতেই , একটা ঘন কালো পিচের রাস্তা সোজা কারুর পেটের ভিতর যেন চলে গেছে। পিচের উপর হালকা আলোর একটা রূপালী আভা, বাকি পুরোটাই একটু বেশি রকমের কালো। অনেকটা দূরে একটা সাদা আলোর বিন্দু দেখা দিচ্ছে। বিন্দুটার একটা চলাফেরাও লক্ষ্য করতে পেরেছে আর্য্য। তীর্থ তো বলেছিল প্রচুর লোক নাকি আসে এই দিনে। কোথাও কোনো মানুষের টিকিও নেই। এতটা মিথ্যে বললো এত দিনের পুরোনো বন্ধু! মনটা কেমন একটা তিতকুটে হয়ে গেল আর্য্যের। -"অন্য কোনো মানুষকে দেখতো না পেয়ে রাগ হচ্ছে? " - একটা ফিসফিসানি । খিলখিল করে একটা হাসিও শুনতে পেল মনে হলো? আর্য্যের পা আর নড়ছে না।  বর্ষার  ছোঁয়া তে হেমন্তের রাত বেশ ঠান্ডা। এর মধ্যে আর্য্যের রুমাল ভিজে গেছে ঘাম মুছে। -"এত ভয় পেলে কিন্তু ভূতের কথা শুনতে পাবি না। এর মধ্যে বেশ কিছু পুরোনো ভূত-বন্ধুর সাথে কথাও হয়ে গেল। একটু কেমন যেন মনঃক্ষুন্ন বলে মনে হল। ভূতেদের নাকি কি সব নতুন করে পঞ্জিকা তৈরী হবে। সেই নিয়ে বেশ একটা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে।" -"আমার ভালো লাগছে না। তুই আসতে বলেছিলিস, আমি এসেছি। এবার চল ফিরে যাই।" -"কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর সূর্য্যের প্রথম গোলাপি আভা আর সেই সময় তুই আবার ঘুমোতে যাবার কথা বলছিস।" মানুষের দুর্বলতা খুঁজে সেটাকে নিয়ে খেলা করার এক পৈশাচিক আনন্দ পায় তীর্থ। অন্ধকারে হাতরে একটা জায়গা খুঁজে পেয়ে বসে পড়লো আর্য্য। একটা ছোট্ট সিমেন্টের চাতালের মতন। চারিপাশ টা কবর দিয়ে ঘেরা। তীর্থের গলার স্বর টা কেমন অন্যরকম শোনাচ্ছে। -"নিজেকে মানুষ না ভেবে, ভূত ভাবতে চেষ্ঠা কর। তোর জীবনে কেউ নেই, তুই আর আর্য্য নেই। তোর আত্মা, তোর শরীরে ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। তুই যে ভাবে খুশি উড়ে বেড়াতে পারিস পাখির মতন। " -"এই ভাবে ভাবা সম্ভব নাকি? " -" আলবাৎ সম্ভব। আমি পেরেছি আর তুই পারিস নি - এই রকম কোনোকিছুই কি হয়েছে আজ পর্য্যন্ত? " যেমন বলা, তেমন কাজ। মনকে কত সুন্দর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে এখন। আত্মার মুক্তি ব্যাপারটা এত সোজা সেটা আজ এখানে না আসলে জানতেই পারতো না আর্য্য। সত্যি তো ! কত কথা এখন শোনা যাচ্ছে। একটু আগের একদম শুনশান চারিদিক এখন বেশ গমগম। ভূতের আলাপ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। চোখটা বন্ধ করে দিতেই প্রথম ভূত এসে হাজির। সুগারের রোগে মড়ার পর এখনো রাতে খাবার পর মিষ্টি খাবার জাগতিক বাসনা থেকে মুক্তি পায় নি। প্রতিরাতে বাড়িতে হানা দেয়। ফ্রিজ খুলে মিস্টি না পেলে রাগের চোটে রান্নাঘরের গোছানো বাসন এলোমেলো করে চলে আসে। মাঝে মাঝেই মাঝরাতে বাসন এলোমেলো হয়ে যাবার ঘটনার ফলস্বরুপ ওনার বাড়ি কাজের মাসীদের ব্ল্যাকলিস্টে উঠে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়ির কাজ নিয়ে শাশুরি-বউএর তরজা উর্ধমুখী। ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিয়েছে। সেই ভয়ে বুড়ি বাড়ির সব কাজ করছে , সকালের রান্না থেকে রাতের বাসন মাজা। এই বয়সে প্রিয়তমার কষ্ট আর সহ্য হয় নি, তাই আজ মিষ্টি ছেড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি। -"আমি ও এবার ফিরে গিয়ে মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেব। বলা যায় না, মড়ার পর এই মিষ্টি খাওয়ার লালসায় মেনকার সাথে ডেটিং টা পিছিয়ে যাবে।" -"তুই তো আর বেঁচে নেই। আর ফিরে যাবার কথা ভাবছিস কেন?" -"এই নাহ। অনেক কাজ শেষ করার আছে। অনেক জায়গা ঘোরার আছে। ফিরতে হবে।" আর্য্য চোখ খুলে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু ঠাওর করতেও পারছে না। তীর্থকেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না অথচ মনে হচ্ছে তীর্থ পাশেই বসে আছে। -" তুই ফেরার কথা ভাবলে কিন্তু আর ভূতদের কথা শুনতে পারবি না"। তীর্থের শান্ত গলায় কেমন এক আদেশের সুর। কোলাহল মুখর আশপাশ আবার নির্জন হয়ে যাচ্ছে। -"ঠিক আছে, আমি বেঁচে নেই। সত্যি বেঁচে থেকে কি লাভ? সকাল থেকে রাত শুধু ছক কষে যাও, কি করে তুমি একটু ভালো থাকবে! ধুস, এটা একটা বাঁচা নাকি। এর থেকে ভূতদের সাথে আড্ডা টা বেশি ইন্টারেস্টিং।" সুগন্ধি বাতাসে আর্য্যের মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। এই গন্ধ তো বেশ চেনা গন্ধ। দ্বিতীয় জন অন্য লিঙ্গের। বাংলা অভিধানে পেত্নী বলে এদের খোঁজ পাওয়া যায়। পত্নী শব্দের উন্মোচনে এদের সাহায্য থাকা বোধহয় অসম্ভব নয়। বরের মোবাইল খুলে মেসেজ দেখার আসক্তি থেকে মুক্তি পায় নি। যতদিন বেঁচে ছিল বরের দেওয়া পাসওয়ার্ড জানতে পারে নি। গভীর আক্ষেপ নিয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে। ভূত হয়ে প্রথম কাজ পাসওয়ার্ড ক্রাক করা। নিমেষের মধ্যে মেসেজ গুলো চোখের সামনে। দু-মিনিটের মধ্যে দশ হাজার মেসেজ পড়া হয়ে গেল। পরকীয়া তত্ত্বের বিন্দুমাত্র লেশ দেখতে না পেয়ে হতাশ পেত্নী এবার পাড়ার সব বিবাহিত পুরুষদের মোবাইল খুলে দেখা শুরু করেছে। হাজার হাজার মেসেজে বন্যা প্রতি রাতে। খোলা মোবাইল শত্রু শিবিরে পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসে। হাতে নাতে ধরা পড়ছে অনেক রাঘব বোয়াল। কারুর আদালতে শমন, আবার কেউ কেউ আত্ম-সমর্পণ করছে ক্ষমাশীল নারীর কাছে। এই মোবাইল ঘেঁটে মেসেজ পড়ার খেলাটা বেশ মনে ধরেছে। গতকাল রাতে একজনের মেসেজ খুলে দেখে প্রচুর মেসেজ, প্রায় হাজার দুই, কিন্তু সব কটা মেসেজ ড্রাফ্ট বাক্সে। প্রেমের কবিতায় সাজানো। খুব ইচ্ছে হতে শুরু করলো, এই রকম মেসেজ যদি ইহলোকে ওকে কেউ পাঠাতো। পরকীয়ার প্রেমের আবেদন তাহলে মনের সুপ্ত কুঠুরি তে এতদিন বন্ধ ছিল। নিজের উপর রাগে, ঘৃণাতে আজ আসক্তি স্বীকারোক্তির প্রহর। -"কি সব মাথা গুলিয়ে দেওয়া ঘটনা রে ভাই। আমার ওই সব মেসেজ গুলো ডিলিট করে দিতে হবে ফিরে গিয়ে। " -"আবার ফেরার কথা! আর তোর মোবাইল তো এখন বাড়িতেই আছে। এতক্ষণে হয়তো কেউ মেসেজ গুলোকে পড়ে ও ফেলেছে।" আর্য্যের মুখ কাঁপছে উত্তেজনা তে। এত বছর যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখা সন্মান মাটিতে লুটোপুটি। এই মুখ নিয়ে ফেরা অসম্ভব। সন্ত্রস্ত আর্য্য তীর্থের হাত ধরতে যায়। অসম্ভব ঠান্ডা হাত। বাবা মারা যাবার পরে এই রকম ঠান্ডা শরীরের প্রথম স্পর্শ পেয়েছিল আর্য্য।হাতটা একটু ওপরে উঠেই নেমে এল। শরীরে কোনো সাড় নেই। -"এই তো প্রায় হয়ে এসেছে। আর একটু ধৈর্য্য ধর, রাতের শেষ প্রহরের আলাপটা শোনা হলেই তোকে ছেড়ে দেব। ভুতেদের নম্বর পাইয়ে দেবার মতন এই রকম পুণ্য চারধাম যাত্রা করেও হয় না। " একটা হালকা গোঙানি ছাড়া আর কিছু প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল না। দালালি করেই সারাজীবন কাটিয়ে আসা মানুষ পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারে নি। চ থেকে ম'এর দালালি। এখানে এসেও সুযোগ খুঁজে ছিল। দুর্ভাগ্যবশত এখনো দালালির ব্যবসাটা ঠিক শুরু হয় নি ভুতেদের সমাজে।  দালালি করার নেশায় বাবাজীবন বেশ কিছু বছর ধরে শ্যাওড়া গাছে বসে আছে। আপাততঃ রাজারহাটের সিন্ডিকেটের দালালি টা বেশ পছন্দ হয়েছে। রাতের বেলাতে বালি-সিমেন্টের লরির চাকা ফাটিয়ে এলাকাতে তুমুল হৈ হট্টগোল পাকিয়ে দালালির মজাটা বেশ উপভোগ্য হয়েছে। মাঝে মাঝে স্বাদ বদলাতে সিনেমা জগতের পর্দার পেছনের দালালির আগাম খবর উড়ো চিঠিতে বোকা বাক্সের চালাক সাংবাদিক কে চালান করে খিক খিক করে হাসে আর লম্বা লম্বা পা দোলাতে থাকে। কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি'র  দিনকাল ভালোই চলছিল। গতসপ্তাহে কথা নেই বার্তা নেই বাবাজীবনের ইহলোকের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের দপ্তর থেকে শমন এসেছে মেয়ের কাছে - বাবার দালালি করে জমানো অর্থের হিসেব বুঝতে চেয়ে। বাবার ব্যবসার অলি গলি খুঁজতে গিয়ে দিশাহারা মেয়ে বিগত পাঁচদিন শহরের বিভিন্ন উকিলের কাছে নতুন করে তাঁর বাবাকে চিনেছে। ছোটবেলা থেকে আদুরে ভালোবাসার ছাওয়ায় বড় হওয়া জীবনের আদর্শ পুরুষের আসল চেহারাটা দেখতে পারার কষ্ট আর নিতে পারে নি মেয়েটি। গতকাল রাতে গলায় দড়ি দিয়ে দালাল বাবার মেয়ে অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে। আত্মহত্যার শাস্তি স্বরূপ মেয়ে এই সমাজে আসবেই আর তাই যে কোনো উপায়ে আজকে বাবাজীবন কে হায়েস্ট মার্কস পেতে হবে। তাঁর জন্য যে কোনো দালালি করতে প্রস্তুত সে। -"গতকাল সকালে শুনছিলাম তোর বাড়িতেও নাকি ই.ডি'র চিঠি এসেছে। কথাটা কি সত্যি আর্য্য?" -"আর বলিস না। লোকাল কাউন্সিলর টা এতটা অপদার্থ কি করে আগে থেকে জানবো? ভবানীভবনে নিয়ে একটু চাপ দিতেই গড়গড় করে আমার নাম বলে দিল! পেটে কথা রাখতে পারে না, পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারে না - এই স্কিল নিয়ে কি রাজনীতি করা যায়? একটা প্রপার স্ক্রিনিং থাকা দরকার সব প্রোমোশনের জন্য।" -"তুই এখন কি করবি? অনেক ঝক্কি সামলাতে হবে তো।" -"তুই তো আমার সব সমস্যার জীয়নকাঠি। আমার তো আর ফিরে যাবার পথ ও নেই। দেখ এখন আর আমার কোনো নিঃস্বাস ও পড়ছে না। কালকে সকালে খবরের কাগজে ফলাও করে বেরোবে - ভূত চতুর্দশী'র রাতে ভবানীপুর কবরস্থানে দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ীর নিথর দেহ। তোর মতন বন্ধু সত্যি পাওয়া যায় না। সমস্ত কলঙ্ক থেকে কি রকম মুক্তি দিয়ে দিলি। আমার ছেলেটা ও বেঁচে গেল।" ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কলকাতার শীতের নরম আদরে সিমেন্টের চাদরে আর্য্যের হিমশীতল মুখটা কি শান্তির। চৌকিদারের সশব্দ চিৎকারে কালীপুজোর ভোরে ভিড় জমতে থাকে।


Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page