স্বীকৃতি পত্র # ১
- Abhijit Chakraborty
- May 9, 2022
- 5 min read

-"আর দশ মিনিট প্লিজ।'
এষানি আজ নাছোড়বান্দা। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়া নিয়ে বাবার সাথে ওর দরাদরি রোজকারের ঘটনা। শুরু হয় দশ মিনিট আরো ঘুমোনোর কাতর অনুরোধ দিয়ে। এষানি এটাও জানে এই রকম দশ মিনিটের ব্যবধানে আরো সাত মিনিট, তিন মিনিট এমন কি এক মিনিটও আসবে দরাদরি তে।
রবিবারের সকাল টা আজ ঝলমল করছে। প্রায় তিনমাস বাদে বাড়িতে কেউ আসছে। কতদিন বাদে দেখা হবে ছোটনের সাথে। এষানি আর ছোটন পিঠোপিঠি মাসতুতো ভাই - বোন। পনেরোর এষানি, গতকাল থেকে দায়িত্ব নিয়েছে বাড়ি টাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার করার। আত্মনির্ভরশীল ভবিষ্যত প্রজন্মের এত ভালো বিজ্ঞাপন পাওয়া দুর্লভ। বাবা উঠলে বিছানা টা পরিষ্কার করতে হবে তারপর বাবার বইয়ের আলমারি টা ধরতে হবে। কতো কাজ ! ছোটন রা এসে পরলো বলে। নাহ্, কোনো ভাবেই বাবাকে আজ ঘুমোতে দেওয়া চলবে না।
-" তুমি কি উঠবে নাকি গায়ে জল ঢেলে দেব?'
-" পাঁচ মিনিট প্লিজ।'
মেয়ে জানে তার বাবার এই আবদার। রোজকার ঘটনা। প্রচুর পাঁচ মিনিটের যোগফল সকাল এগারোটা। মাকে অনেকবার বলেছে , বাবাকে একটু সকাল সকাল উঠতে বলো। মা জানে , কোনো লাভ নেই আর তাই অযথা শক্তিক্ষয় করে লাভ নেই। সারারাত ধরে একটা মানুষ জেগে থাকলে সে বেলা করে ঘুমোবে এর মধ্যে আশ্চর্যের কি আছে ! সারারাত ধরে নাকি বাবা কে ভাবতে হয়। রাতের চিন্তায় নাকি একমাত্র সূত্র গুলো ধরা দেয়। জটিল ভাবে পাকিয়ে থাকা সুতোগুলোর জট ছাড়ানোর নেশা রাতের বেলাতেই জমে ভালো। মাঝে মাঝে অবশ্য বাবা এই খেলাতে ওকে ও খেলতে নেয় । প্রথম প্রথম বাবার প্রশ্ন গুলো ঠিক বুঝতে পারতো না। এখন দুয়ে দুয়ে চার করার একটা তত্ত্ব খাড়া করে আর সেটা বেশ মাঝে মাঝে মিলেও যায়। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষ অফিসার স্বপ্নীল চ্যাটার্জী'র সহকারী হিসাবে নিজেকে ভাবতে এষানি র বেশ ভালো লাগে। প্রথম প্রথম বাবা কি করে কেস গুলোর নিষ্পত্তি করে সেটা শুনতে বেশ রোমাঞ্চ লাগতো। এখন গা সয়ে গেছে। বুঝতে পেরেছে এটাও অনেকটা ওই অফিস যাবার মতনই ব্যাপার। অপরাধ ধরার কৌশল টা ভীষণ রকম একঘেয়ে । কর্পোরেট সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর। সেই একঘেয়ে কাজের জন্য বাবার সারারাত জাগার সার্থকতা খুঁজে পায় না।
-"কি গো উঠবে নাকি সত্যি গায়ে জল ঢালবো?'
- " আর দু মিনিট মা। মাকে একটু বল চা দিতে, চা এলেই উঠে পরবো । '
দুষ্টের ছলনার অভাব হয় না । মা কে বললেও মা চা করে দেবে না, কারণ চা বিছানার পাশের টেবিলে পরে থেকে ঠান্ডা হবে। পরিশ্রমের কোনো ফল না পেলে কার আর সেই কাজটা করতে ভালো লাগে ! এষানিই এখন চা করে, সেই চা টাও ঠান্ডা হবে জেনেও। আজকে বাবার সব বায়না সহ্য করতে হবে। এষানি'র আজ বাবাকে খুব দরকার। ছোটনের জন্যে বাবা কে আজ একটু তোষামোদ করতেই হবে। বাবা ই একমাত্র ছোটনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। ছোটন ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হবে, মেসো - মাসী দুজনেই বিপক্ষে। এই সময় একমাত্র বাবা ই পারে মেসো - মাসীকে বোঝাতে। বাবা যখন কোনো ব্যাপারে কাউকে বোঝায় সেটা এষানি তন্ময় হয়ে শোনে। বাবার মতন কাউকে এত প্রত্যয়যোগ্য ব্যাখ্যা দিতে শোনে নি। বাবার এই গুণ টাকে খুব শ্রদ্ধা করে মেয়ে। মাঝে মাঝেই ভাবে, বাবা বোধহয় অপরাধের আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সূত্র গুলোকে একসাথে যোগ করে একটা প্রতিপাদ্য নির্দিষ্ট করে আর তারপর যুক্তি আর প্রত্যয়ী ব্যাখ্যা দিয়ে অপরাধীকে দোষী প্রমাণিত করে। অপরাধী খোঁজার কাজটা কতটা বুদ্ধির আর কতটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের , সেটা নিয়ে একটা ধোয়াশা আছে এষানি'র।
-"বাবা চা হাজির। এবার উঠে পরো প্লিজ। '
ঘুম না যাওয়া , আধো চোখে মেয়ের আদুরে কাচুমাচু মুখ টা দেখে স্বপ্নীলের খুব মায়া হচ্ছে । এই তো সেদিনের হামাগুড়ি দেওয়া মেয়েটা কত বড় হয়ে উঠছে। আজকাল আবার নিজে নিজে কন্টিনেন্টাল রান্না করছে ইউ-টিউব দেখে।
-"কি ব্যাপার বল তো মা, আজকে সুর এত নরম কেন?'
-"ছোটনরা এক্ষুনি এসে যাবে। এখনো ঘর গোছানো হয় নি" - কি করে বোঝাবে যে ছোটনরা আসার আগে বাবা কে ছোটনের মনের ইচ্ছে টা জানাতে হবে, বাবা কে রাজি করাতে হবে। সরাসরি বললে কাজ নাও হতে পারে।
-"জানো বাবা, ছোটন আজকাল কি ভালো ছবি আঁকছে। কাল কে ফেসবুকে সুশান্ত সিং রাজপুতের একটা ছবি এঁকেছে আর পোস্ট করার একঘন্টার মধ্যে সাড়ে চারশো লাইক !'
- "বাহ খুব ভালো তো। তুই একদম শিওর তো যে ওর ছবি আঁকার গুণে ও অতগুলো লাইক পেয়েছে । মানুষের সহানুভূতি র প্রকাশ নয় তো? '
-" যাহ বাবা, ছোটন কেন সহানুভূতি পেতে যাবে?'
-" ছোটন পাবে কেন? ছবির বিষয় তো পেতে পারে।'
-" আজ ও এলে তুমি জিজ্ঞাসা করে নিতে পারো, ওই ছবির বিষয় টা, নায়ক না হয়ে নায়কের মনের ভাবও তো হতে পারে । '
স্বপ্নীল এক লাফে বিছানাতে উঠে বসেছে। ছোটন বিষণ্ণতার ছবি আঁকছে ?
-"আচ্ছা বাবা একটা প্রশ্ন। তুমি তো গোয়েন্দা। সুশান্তের আত্মহত্যা টা কি ডিপ্রেসন থেকে না অন্য কিছু ব্যাপার আছে।'
-"মুম্বাই পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে । এক্ষুনি কিছু বলা যাবে না। ইনভেস্টিগেশন কি মুড়ির মোয়া? সময় লাগে। এভিডেন্স জোগাড় করে তার অ্যানালাইসিস করতে হয়।'
লকডাউনের পর থেকে কেমন যেন এক আত্মহত্যার হিড়িক উঠেছে। বেশ কয়েক দিন ধরে স্বপ্নীলও একটা আত্মহত্যার কেসের মধ্যে ঘেঁটে আছে। ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে সুতো খোলার কাজ সেটা নিয়ে ধন্ধে। সপ্তাহ দেড়েক আগে কেসটা ওর হাতে আসে। কলকাতার বহুতল বাড়ির ছাদ থেকে বছর বাষট্টি এক প্রৌঢ়ের আত্মহত্যা। স্বচ্ছল পরিবার। অধ্যাপক। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ্ হিউম্যান জেনেটিক্সের সদস্য। বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। এই রকম মানুষ হটাৎ ডিপ্রেসন থেকে আত্মহত্যা করবে এটা ঠিক মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে স্বপ্নীলের। ময়না তদন্তে কোনো বিশেষ কিছু পাওয়া যায় নি। সেরিব্রাল ফ্লুইডে একটু বেশি মাত্রায় হাইড্রক্সি ইনলাক অ্যাসিটিক অ্যাসিড পাওয়া গেছে, যেটা প্রচুর আত্মহত্যার ঘটনাতে দেখা যায়। ভদ্রলোক কোনো অ্যান্টি ডিপ্রেসন মেডিসিন নিতেন বলে জানা যায় নি। ছেলে বিদেশে পড়ছে, মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে খুশিতে আছে, স্ত্রীয়ের সাথে সদ্ভাব বলেই জানা গেছে। ফ্যামিলি হিস্ট্রি তে কোনো পূর্ব আত্মহত্যার ঘটনা জানা নেই। এমনি এমনি কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া একটা মানুষ আত্মহত্যা করে নিল? তাহলে ওই চিঠি গুলোর সাথে কি কোনো সম্পর্ক আছে ?
-"বাবা, একটা কথা ভাবছিলাম, যে কোনো মানুষ হটাৎ আত্মহত্যা করতে পারে?'
- " আত্মহত্যা টা একটা বেশ জটিল ব্যাপার । বিজ্ঞান বলে - যে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না। বিশেষ কিছু জিনের প্রভাব এই মানুষ গুলোর উপর প্রবল। বিশ্বে এই নিয়ে এখন প্রচুর গবেষণা ও চলছে। বেশ কিছু বিজ্ঞানী এটা দাবিও করেছেন যে ডি এন এ পরীক্ষায় এটা নির্ভুল ভাবে প্রমাণ করা যায় যে কে আত্মহত্যা করতে পারে আর কে পারে না?'
-"তাহলে তো তোমাদের খুব সুবিধা, ময়না তদন্তে ওই জিনের অস্তিত্ব দেখে নিলেই তো বোঝা যাবে যে সেটা হত্যা না আত্মহত্যা।'
-"আইন এখনো এই তত্ত্বের স্বীকৃতি দেয় নি মা। আর আমাদের এখানে সেই পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই।'
বাবার সাথে কথা বলার এই এক অসুবিধা। ট্র্যাক হারিয়ে যায় । কোথায় ছোটনের ছবি আঁকা আর কোথায় এই বিচ্ছিরি আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা।
এষানি এক লাফে দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে মোবাইল টা নিয়ে এসে ইনস্টাগ্রাম খুলে বাবাকে ছোটনের আঁকা ছবি টা দেখায়। স্বপ্নীল এক দৃষ্টে ছবিটার দিকে তাঁকিয়ে আছে।
-"ছোটন তো বেশ ভালো আঁকে।'
-"তাই তো বলছি বাবা।'
-"ভালো, আঁকা টা ছাড়তে বারণ করিস।'
-"তাতে তোমার একটু সাহায্য লাগবে বাবা।'
-" আমার?'
গাড়ি এসে গেছে নিজের রাস্তা তে। পরবর্তী আধঘন্টার বাবা - মেয়ের যুক্তি ও ভালোবাসার দরাদরি, স্বপ্নীলকে নিমরাজি করানো গেছে বড় মাসীর সাথে কথা বলানোয় । এষানি'র খুব ইচ্ছে করছে গলা জড়িয়ে বাবা কে আদর করতে।
আরো এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না। স্বপ্নীলের মাথা তে চিঠি গুলো ঘুরপাক দিচ্ছে। নিশীথ বাবুর ঘর থেকে পাওয়া চিঠি গুলো। ওটাই কি তাহলে একমাত্র সূত্র, জট ছাড়ানোর?
কলিং বেলের আওয়াজ ভাবনাটা ভেঙে দিল। বসার ঘরের থেকে গলার আওয়াজ বলে দিচ্ছে - বাপের বাড়ির লোক এসেছে।
(চলবে)
Comments