top of page

#স্বীকৃতি পত্র # ৩

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • May 26, 2022
  • 5 min read

কাজের চাপ থাকলে, সকাল সকাল ঘুম টা ভেঙ্গে যায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। লালবাজারে অফিসে ঢোকার আগে, রথীন সেনের সাথে দেখা হয়ে গেল। রথীন অনেক দিনের সহকর্মী। এই নিশীথ সেনের কেসটা তেও ওর সাথে কাজ করছে।


-"স্বপ্নীল দা, কেস টা ক্লোজ করে দি?'

-"আরো কয়েক টা দিন দেখি, তারপর না হয় একটা ফাইনাল ডিসিশন নেওয়া যাবে।'


রথীনের চোখ চক চক করে উঠেছে। ও জানে এই উত্তরের মানে।

-"আমরা কি তাহলে কোথাও যাচ্ছি এখন?'

-"হ্যাঁ। বৈষ্ণবঘাটা।' স্বপ্নীলের ছোট উত্তর ।


বৈষ্ণবঘাটা জায়গাটা স্বপ্নীলের বেশ ভালো লাগে। বর্ধিত কলকাতার সাজানো গোছানো রাস্তাঘাট, বিশাল ঝিল, দেশলাইয়ের বাক্সের মতন লাইন দিয়ে সাজানো চারতলা ঝকঝকে বাড়ি গুলোর মধ্যেই শিবালিক অ্যাপার্টমেন্ট কে খুঁজে নিতে বেশি সময় লাগে নি।


দু - কামরার ছিমছাম সাজানো ফ্ল্যাট। খুব অল্প আসবাব পত্র। যেটুকু সাজানো তার মধ্যেই এক সুস্থ সুন্দর রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। ড্রইং-কাম ডাইনিং রুমের দেওয়াল গুলোতে ফ্রেমে সাজানো বেশ কিছু ছবি। মাধুরী দাশগুপ্তের নিজের কয়েকটি ছবিও জায়গা করে নিয়েছে অবনীন্দ্রনাথ আর বিষ্ণু দে 'র মাঝখানে।


নিজের পরিচয় দিয়ে নিশীথ বাবুর মৃত্যু ও তাঁর সম্ভাব্য কারণ নিয়ে প্রশ্ন করতে চাওয়ায় স্বপ্নীলকে কোনো আপত্তির সম্মুখীন হতে হয় নি মাধুরীর থেকে। নিশীথ বাবুর মৃত্যুর খবর মাধুরীর মুখের মধ্যে এক সাময়িক শোকের আবহাওয়া এনে দিলেও, প্রশ্নোত্তর পর্বে মাধুরী সাবলীল এবং স্পষ্ট।


জিজ্ঞাসাবাদ শেষে, গাড়িতে আসার পথে ডায়েরির পাতা ভরে উঠলো কিছু অসংলগ্ন শব্দ ও বাক্যে। অবিবাহিতা, অধ্যাপিকা, বিয়াল্লিশ, গোপন/গভীর পরিচিতি, মৃত্যুর খবর কেন পেল না?, রবীন্দ্রসংগীত, সুইসাইড রিসার্চ, মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ, শেষ দেখা বছর তিনেক, স্বচ্ছল।


-"স্বপ্নীল দা, কোন ইন্টারেস্টিং ক্লু তো পাওয়া গেল না কথা বলে। একটু থানায় ডেকে নিয়ে কথা বললে কিছু ভালো জিনিষ বেরোতে পারতো না?'

-"একজন সম্ভ্রান্ত মহিলাকে থানায় ডেকে পাঠানোর জন্য একটা উপযুক্ত কারণ থাকা কি দরকার নয়? উনি কি আমাদের সাথে কোনো অসহযোগিতা করেছেন?'

-"না ঠিক সেটা নয়। কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছে , উনি এই মৃত্যু সম্বন্ধে আগে থেকে জানতেন, আজকে আমাদের থেকে প্রথম শোনেন নি।'

-"সন্দেহ করার যথার্থ কারণ না খুঁজে পেলে শুধু শুধু একটা মানুষ কে খুনি না ভাবলেও চলে। আপাতত খুব খিদে পেয়েছে, পেট না ভরলে মাথা কাজ করবে না।'


স্বপ্নীলের আজকে একবার নিশীথ বাবুর বাড়ি যাওয়া দরকার। গত সপ্তাহে শুধু একবার প্রমিতা দেবীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু উনি শোকের ধাক্কা কাটিয়ে কোনো কথা বলতেই পারছিলেন না। এক সপ্তাহে আশা করা যায়, প্রাথমিক শোকের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। নিশীথ বাবুর ছেলের সাথেও কথা বলতে হবে কারণ বাবার কাজ শেষ হলেই আর দিন দশেকের মধ্যে ছেলে ফিরে যাবে মার্কিন মুলুকে।


সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে এষানির সাথে গল্প স্বপ্নীলের জীবনের রোজ নামচা। আজকে তার ব্যতিক্রম। গতকালকের ব্যর্থতার শাস্তি। স্বপ্নীল মেয়েকে ভালো চেনে। এখন বেশ কিছুদিন কথা প্রায় বন্ধ থাকবে। একটা অসহযোগ আন্দোলনের ছাপ। একদিক দিয়ে ভালো। বাকি চিঠি গুলো শেষ করতে হবে। ল্যাপটপের ব্যাগের থেকে নোটের খাতা আর চিঠি গুলো বার করে, স্বপ্নীল ডুবে যায় রহস্য খোঁজার নেশায়।


প্রাপক : নীতিন সেন। মার্কিন মুলুকের ঠিকানা, সান হোসে, ক্যালিফোর্নিয়া।

নীতু,

অনেকদিন ধরেই তোকে একটা কথা জানাবো বলে ভাবছি কিন্তু বলে ওঠা হচ্ছে না। কাজ নিয়ে তোর দুশ্চিন্তার কথা মিতার থেকে শুনলাম। ছেলে বড় হচ্ছে, ওকেও তোর একটু সময় দেওয়া দরকার। ব্যবসার ভালো মন্দ লেগেই থাকে। সেই ভালো মন্দের ছাপ ডিনার টেবিলে না পড়লেই মঙ্গল।


পারলে বেশি করে গান শোন। খেলাটা কে ছাড়িস না। ড্রিংকস টা একটু কমানোর চেষ্টা কর, ঘুমের ওষুধের ব্যবহারটা খুব দরকার না হলে বন্ধ করে দে। জীবনের সাফল্যের পরিমাপ করার কোনো নির্ভুল যন্ত্র এখনও আবিষ্কার হয় নি। ভালোবেসে যেটা করতে পারবি শুধু সেই টুকুই করিস। নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার কোন দায় নিয়ে জীবন কে অতিষ্ঠ করে তুলিস না।


জিততে চাওয়া একটা নেশা। এই নেশা থেকে মুক্তির কোনো ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয় নি। নিজেকে ভালবাসিস।


ইতি বাবা।


স্বপ্নীলের খাতা ভরে উঠছে বাবা ছেলের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের সমীকরণ ঘিরে। বিকেলে নীতিনের সাথে কথা বলার সময় অবশ্য এই বন্ধুত্বের কোনো আভাস স্বপ্নীল খুঁজে পাওয়া যায় নি। বরং প্রমিতা দেবীর সাথে কথা বলার সময় এটা টের পেয়েছিল যে, ইদানিং মাস ছয়েক ধরে বাবা-ছেলের মধ্যে একটা বিরোধ কাজ করছিল। নীতিন বাবার থেকে আর্থিক সাহায্য চায়। নীতিশ বাবুর শর্ত ছেলেকে দেশে ফিরে আসতে হবে , তাহলেই উনি আর্থিক সাহায্য করবেন। শর্তসাপেক্ষ সাহায্য নিয়েই বাবা আর ছেলের মতবিরোধ।


পরের চিঠি টা পড়বার আগে, একটা সিগারেট ধরিয়ে সাত তলার বারান্দা থেকে কলকাতার নিস্তব্ধ ঘোলাটে আকাশের মধ্যে স্বপ্নীল প্যাটার্ন খুঁজছে - চিঠি গুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত রহস্যের। বিগত এক সপ্তাহে নীতিশ বাবুর সমন্ধে যা যা তথ্য খুঁজে পেয়েছে তাতে ওনাকে অজাতশত্রু বলেই ধরা যেতে পারে। তিরিশ বছরের উপর অধ্যাপনা করেছেন দেশে - বিদেশে। ছাত্র ছাত্রীদের খুব প্রিয় শিক্ষক হিসাবে নাম ডাক। রাজনীতির সাথেও কোনো ভাবে যুক্ত নন। সরকারি নজর এড়িয়ে নিজের মনে জ্ঞান সাধনা করে গেছেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের জন্মলগ্ন থেকে জড়িত। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সাম্মানিক লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া আর স্টান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটি তে প্রতি বছর স্পেশাল ক্লাস নিতে যার ডাক পড়ে, তাকে হটাৎ করে কে খুন করতে যাবে? সবচেয়ে বড় কথা কেন ই বা করতে যাবে? একটা সহজ সরল আত্মহত্যা কে জটিল খুন হিসাবে ভাবাটা একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? স্বপ্নীল যতবার এই কেস টাকে আত্মহত্যা হিসাবে ভাবার চেষ্টা করছে, ততবার ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে খুঁচিয়ে তুলছে।


এখনো যতগুলো চিঠি পড়েছে, তার মধ্যে একটা উল্লেখ্যযোগ্য ব্যাপার হলো, চিঠি গুলোর একদম উপরে একটা করে ডেট আছে, কিন্তু তারিখের মধ্যে কোনো বছরের উল্লেখ নেই। এই যেমন প্রথম চিঠি, অর্থাৎ সুবিমল বাবু কে লেখা - ৭ই ডিসেম্বর। দ্বিতীয় চিঠি - ১৭ই জুলাই বাবা কে লেখা। তৃতীয় চিঠি, মাধুরী দেবী কে - ২৫শে এপ্রিল। চতুর্থ চিঠি - ২১শে আগস্ট। যিনি আত্মহত্যা করবেন তিনি এই রকম গুছিয়ে চিঠি লিখে সেগুলো কে নিজের কাজের টেবিলের উপর সযত্নে রেখেও দেবেন - এটা কি কাকতালীয় ?


মনের ভাবনায় ছেদ ফেলে, পঞ্চম চিঠি টা খুলে ফেলে স্বপ্নীল। ৫ই অক্টোবর। প্রাপক - কৌশিক সেনগুপ্ত, বিবেকানন্দ পল্লী, মগরা।


প্রিয়বরেসু কৌশিক,

আশা করি তনু ও তুমি কুশলে আছ। অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয় নি। তোমার ব্যস্ততা জানি বলেই তোমাকে বিরক্ত করতে কুণ্ঠা বোধহয়। শিক্ষক হিসাবে তোমার মতন ছাত্রের সাফল্যে নিজেকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্ঠা করি, যাতে আরও কিছু কৌশিক গড়তে পারি।


বিদেশের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জীবন কে অবহেলায় সরিয়ে দেবার শক্তি টা কোথায় পাওয়া যায়, সেটা তোমার থেকে শিখতে ইচ্ছে করে। দেশ গড়ার অঙ্গীকার কার জন্য? আজকাল আমার খুব কষ্ট হয় নিজের জন্য। নিজের দেশ কে ভালোবাসতে না পেরেও নিজের আপনজন কে দেশে ফিরতে অনুরোধ করি। দ্বিচারিতা কে এই ভাবে নিজের মধ্যে খুঁজে পাব, আশা করি নি। মানসিক দ্বন্ধ কি শুধু আমার? স্বান্তনা খুঁজে বেড়াই। আমার মতন যদি আরও কেউ থাকে?


তনুর হাতের তেল কই আর পাবদা সর্ষে খেতে খুব তাড়াতাড়ি একদিন দেখা করবো।

ভালো থেকো আর তোমরা দুজনেই আমার আর্শীবাদ নিও।


- ইতি স্যার।


সমবয়সী দুটো মানুষ, নীতিন এবং কৌশিক এক ত্রিভুজের দুই কোণে। একজন দেশে ফিরতে চায় না, অন্যজন বিদেশের অর্থ, বৈভব ত্যাগ করে দেশের মাটির গন্ধ নিয়ে বাঁচতে চায়। ত্রিভুজের শেষ কোণে নীশিথ সেন, দ্বিচারিতার দ্বন্দ্ব নিয়ে উথাল পাতাল।


স্বপ্নীলের খাতাতে আরো কিছু আঁকিবুকি যোগ হলো। কৌশিক সম্বন্ধে একটু খোঁজ নেওয়া দরকার। এত রাতে রথীন কে কি ফোন করা ঠিক হবে? একটা মেসেজ করে দেখা যাক, যদি জেগে থাকে।


- "কোন নতুন ক্লু পেলে না কি স্বপ্নীল দা?' - মেসেজের উত্তর আসতে দু মিনিটের বেশি সময় লাগে নি।

-"একটা লোক সম্বন্ধে একটু খোঁজ খবর দরকার।'

-"এখন ই?'

-"আরে না না, কাল দুপুরের মধ্যে পেলেই হবে।' সহকারীর উৎসাহ ও উদ্দীপনার কোনো অভাব নেই।


প্রাথমিক খবর জোগাড় করেই কালকেই কৌশিকের সাথে দেখা করার প্ল্যান টা ফাইনাল করে নিল স্বপ্নীল আর রথীন। ঘড়ির কাঁটা বলছে প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। আরো কয়েকটা চিঠি শেষ হলেই চিঠি পর্ব শেষ হয় কিন্তু মাথা টাকে একটু রেস্ট দেওয়া দরকার।


শোবার ঘরে ঢোকার আগে, একবার মেয়ের ঘরে উঁকি দিল। এষানির অকাতরে ঘুমিয়ে থাকা নিষ্পাপ মুখ টা দেখে একটা দুমড়ানো মুচড়ানো কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠছে। আজ সারাদিন বাবা-মেয়ের মধ্যে কোনরকম কথা হয় নি । অভিমান আর ভালোবাসার মিশেলের অনুভূতির কোনো বিশেষণ হয় না।


কাল বাড়ি ফিরে প্রথম কাজ, অসহযোগ আন্দোলনের ইতি টানা।


(চলবে)



Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page